বোয়িং চুক্তি: সংস্কারের নামে কি সার্বভৌমত্ব আত্মসমর্পণ?

Boeing contract

বোয়িং চুক্তি: সংস্কারের নামে কি সার্বভৌমত্ব আত্মসমর্পণ?

একসময় যে স্লোগান দিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তাল করা হতো—”দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে!”—আজ যেন সেই স্লোগানেরই বাস্তব রূপ দেখছে বাংলাদেশ। ক্ষমতার পালাবদলের পর সংস্কারের যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা এখন বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির সাথে অস্বচ্ছ চুক্তির আড়ালে চাপা পড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে, মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং-এর সাথে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, তা দেশের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে এক বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।

বোয়িং চুক্তি: সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বনাম কর্পোরেট আত্মসমর্পণ

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি ছিল স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার। বলা হয়েছিল, কোনো গোপন চুক্তি হবে না, রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্ত জনগণের সামনে খোলাসা করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলছে?

ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় সংস্কারের নামে যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো কিছু প্রশাসনিক রদবদল এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির সামনে এক প্রকার নতিস্বীকার। সাধারণ মানুষের জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব কোথায়?

  • দুর্নীতি: প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা দুর্নীতি কি কমেছে? উত্তরটি பெரும்பாலும் ‘না’।

  • মত প্রকাশের স্বাধীনতা: এখনও কি মানুষ নির্ভয়ে মত প্রকাশ করতে পারছে?

  • অর্থনীতি: ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১২৫ ছাড়িয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংকট আগের মতোই তীব্র। ব্যাংকিং খাত লুটেরাদের দখলেই রয়ে গেছে।

এই যদি হয় সংস্কারের চিত্র, তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক—এই সংস্কার কার স্বার্থে? জনগণের, নাকি ওয়াশিংটন কেন্দ্রিক কর্পোরেট শক্তির?

 

বোয়িং চুক্তি: একটি অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ বোঝা

বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার চুক্তি। এই চুক্তির আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমান রিজার্ভ সংকটে ভোগা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বিশাল বোঝা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, চুক্তিটি একটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (NDA) বা গোপনীয়তার মোড়কে করা হয়েছে। এর অর্থ হলো:

  • দাম অজানা: প্রতিটি বিমান ঠিক কত দামে কেনা হচ্ছে, তা জনগণ জানতে পারবে না।

  • শর্তাবলী গোপন: ঋণের সুদ কত, পরিশোধের শর্ত কী, বা অন্য কোনো গোপন শর্ত আছে কিনা, তা জানার উপায় নেই।

  • লাভ-ক্ষতির হিসাব নেই: জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’ এই বিশাল বিনিয়োগ থেকে আদৌ লাভবান হবে কি না, তার কোনো স্বচ্ছ বিশ্লেষণ সামনে আনা হয়নি।

বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে ৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির বাজার রক্ষা করতে এই চুক্তি করা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে পোশাক খাতে ৩৫% শুল্ক আরোপের হুমকি এসেছে। তাহলে কি এই চুক্তি দর কষাকষির হাতিয়ার, নাকি জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপ?

বোয়িং চুক্তি: এয়ারবাস বনাম বোয়িং একটি কূটনৈতিক জুয়া?

মাত্র দুই বছর আগে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর ঢাকা সফরে ৩.২ বিলিয়ন ডলারে ১০টি এয়ারবাস কেনার একটি স্বচ্ছ চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছিল এবং ইউরোপের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এমনকি বর্তমান সরকারের প্রতিনিধিরাও সম্প্রতি লন্ডনে এয়ারবাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন।

তাহলে হঠাৎ করে সব আলোচনা থামিয়ে বোয়িং-এর দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ কী?

  1. এয়ারবাস চুক্তি কি বাতিল? যদি তাই হয়, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, এটিকে একটি বড় কূটনৈতিক অপমান হিসেবে দেখতে পারে।

  2. দুটি চুক্তিই কি বহাল থাকবে? যদি এয়ারবাসের ১০টি এবং বোয়িং-এর ২৫টি—মোট ৩৫টি নতুন বিমান কেনা হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে, এই বিপুল সংখ্যক বিমান দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কী করবে? যেখানে লাভজনক রুটগুলো (যেমন: জাপান) যাত্রী সংকটে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ঢাকা-নোয়াখালী রুটে তো আর বোয়িং চালানো সম্ভব নয়।

এই সিদ্ধান্তটি কি বাংলাদেশকে একটি একপাক্ষিক ও আত্মঘাতী কূটনৈতিক জুয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে না?

বোয়িং চুক্তি: চুক্তির আড়ালে আরও ভয়ঙ্কর শর্ত?

শোনা যাচ্ছে, এই চুক্তির পেছনে রয়েছে আরও কিছু অদৃশ্য কিন্তু ভয়ঙ্কর শর্ত, যা সরাসরি দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানতে পারে। যেমন:

  • চীনা সামরিক সরঞ্জাম কেনায় নিষেধাজ্ঞা।

  • বাংলাদেশের কাস্টমস ডেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর।

  • গ্যাস খাতে মার্কিন কোম্পানিকে একচেটিয়া সুবিধা প্রদান।

  • মার্কিন FDA অনুমোদন ছাড়া ওষুধ আমদানিতে বাধা।

এগুলো যদি সত্যি হয়, তবে এটি নিছক একটি বাণিজ্যিক চুক্তি নয়, বরং একটি স্বাধীন দেশকে কর্পোরেট উপনিবেশে পরিণত করার নীলনকশা।

বোয়িং চুক্তি: শেষ কথা
সরকার পরিবর্তন মানে যদি শুধু ক্ষমতার হাতবদল হয়, নীতির নয়, তাহলে সাধারণ মানুষের ভাগ্য কি আদৌ বদলাবে? জনগণ যদি দেশের সম্পদের হিসাব না পায়, চুক্তির শর্ত না জানে এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে মতামত প্রকাশের অধিকার না রাখে, তাহলে গণতন্ত্র শব্দটি শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।

দেশ কোনো কর্পোরেট প্রজেক্ট নয়, যেখানে জনগণ শুধু ঋণ শোধ করবে আর শাসকের সিদ্ধান্তে হাততালি দেবে। বোয়িং চুক্তি নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলোর স্বচ্ছ উত্তর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

 

Preyavihar Temple: ৯০০ বছরের পুরোনো মন্দির কেন যুদ্ধের কারণ? নেপথ্যে কী?

Scroll to Top