চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান আহমদ শফীর কাছে মাথা নিচু করে দোয়া চাওয়ার ছবিটায় খালি রাজনীতি খুঁজলে অন্ধের হস্তি দর্শনের মত বিভ্রান্ত হবেন। এটা বুঝতে পারবেন যখন রাজাকার পীরকে আটক করেও মুক্তিযোদ্ধার পা ছুঁয়ে সালাম করার ঘটনার কথা আপনি জানবেন। হেফাজত ইসলাম আর আওয়ামী লীগের এই মিলন তেল আর জলের মিশ খাওয়া নয়, বরং বলা চলে ৫০ বছর পর পূর্ণমিলনী হলো…।
আওয়ামী লীগের ‘ধর্ম বিরোধী’ ট্যাগ খাওয়া একটা ট্রাজিডী। হুজুররা বেঈমান না হলে এই উপমহাদেশ জুড়ে মুসলিম রাষ্ট্র, তাদের রাজনীতির জন্য পাকিস্তান আন্দোলনের বীরদের ‘ধর্মবিরোধী’ বলে মিথ্যাচার করত না। ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ব বাংলা মুসলমানদের দেশ। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে আমরা দেখেছি তখনকার মুসলিম জাতীয়তাবাদ কতটা প্রকট আকারে ধারণ করেছিলো। সেই জাতীয়তাবাদ ৬০-এর দশকে এসে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ রূপ নেয় নেহাত জাতিগত স্বার্থে। বাঙালীরা পাঞ্জাবী-পাঠানদের মত মুসলমান হলেও বাঙালী পরিচয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল, কাজেই বাঙালী পরিচয়ে অধিকার আদায় করতে হয়েছিলো। তাই বাঙালী জাতীয়তাবাদ কিছুতে সেক্যুলার মুভমেন্ট ছিলো না। ৬ দফার আগে পূর্ব পাকিস্তানে অবিশষ্ট হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হয় নাই। কারণ এই আওয়ামী লীগই সাবেক মুসলিম লীগ পরিচয়ে বাঙালী হিন্দুকে পূর্ব বাঙলা থেকে উচ্ছেদ করেছিলো। হিন্দু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যারা ৬৫ সালের আগ পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে, তাদের পার্টিই ছিলো কমিউনিস্ট। ৬৫ সালের শত্রু খতম, ভারতের দালাল ইত্যাদি হুলিয়াতে এই অংশটি ভারতে মাইগ্রেট করতে বাধ্য হয়। ৬ দফার পরই বাংলার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, হয়ত লীগই এমন একটা পরিবেশ দিবে যেখানে তারা নিশ্চয়তা নিয়ে বসবাস করতে পারেন…। তাদেরই আস্থা কিছুতেই দলটিকে সেক্যুলার ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলেনি। ৭ মার্চের ভাষণের আগেও কুরআন তেলায়াত করা হয়েছিলো…।
আওয়ামী লীগ সেক্যুলার দল- এরকম দাবী আওয়ামী লীগের ঘোর সমর্থনকারী কেউ করলে তার গলা চেপে ধরবে বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতারা। আওয়ামী লীগ হচ্ছে সবচেয়ে ধর্মপ্রাণ ইসলামি মাইন্ডের দল। দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি সংগঠন হেফাজত ইসলাম এই দলের জন্য দোয়া করে। তাদের খেদমত তথা ইসলামের খেদমতের জন্য আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় অর্থ দুহাতে ব্যয় করে। আওয়ামী লীগের দুই-চারজন সেক্যুলার-নাস্তিক ফেইসবুক এক্টিভিস্ট লীগের এইসব কাজে বিব্রত হলেও ৯৯.৯৯ শতাংশ লীগ সমর্থকরা তাদের দল নিয়ে চায়ের টেবিলে ঝড় তুলে- এর আগে কে কবে ইসলামের এতখানি খেদমত করেছে?
সমগ্র পৃথিবীতে ‘মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ’ করার জন্য দেশভাগের দ্বিতীয় নজির নেই। এই কাজটি শফী হুজুরদের বিগত হওয়া মুরব্বিরা করেননি, চিন্তাও করতে পারেননি। যারা করেছিলেন তারা ৭১ সালে সেই পাকিস্তান ভাঙ্গার কারণে যে ভুলবুঝাবুঝি ঘটে গিয়েছিলো তার অবসান হলো বলা চলে। আহমদ শফী কয়েকদিন আগেই বলেছিলেন, কওমি সনদ নিয়ে তাদের মুরব্বীরা বহু দেনদরবার করেছিলেন কোন লাভ হয় নাই। এই অসাধ্য কাজটা শেখ হাসিনা করে দিয়ে তাদের বুনিয়াদ দৃঢ় করে দিয়েছেন।
বিশ-পঁচিশ বছর পর যখন সংসদে মৌলবী মোল্লারা জাঁকিয়ে বসবে, আধা আফগানিস্থান স্টাইলে দেশ চলবে তখন আওয়ামী লীগের গুটি কয়েক সেক্যুলার-নাস্তিক বন্ধুরা পল্টি খেয়ে ভিন্ন ইতিহাস বয়ান করতে পারেন তাই এই ক্ষণে তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সেই দিনটির বিজ এই সময়ই রোপিত হয়েছিলো- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেফাজত ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন, “হেফাজতে ইসলাম কখনো আমাদের শত্রু ছিল না। কওমি মাদ্রাসার মান দিয়ে তাদের উপকার করেছি। তাই তারা দোয়া করছে। তারা যদি আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও সমস্যা নেই বলে থাকে, তাহলে তাদের আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। …তাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো মূল্যায়ন ছিল না। কওমি মাদ্রাসার মান দেওয়ার মাধ্যমে তাদের রুটি-রোজগারের একটি ব্যবস্থা হবে। আমরা তাদের ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে দিয়েছি…”।
দেশ স্বাধীন হবার পর ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন করাও ছিলো মোল্লাদের খুশি করার উদ্দেশ্য। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের আপত্তি স্বত্ত্বেও ওআইসিতে যোগ দিয়ে ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ স্বীকৃতি আদায় বাংলাদেশকে ইসলামিকরণের সূচনা বলা চলে। তারপর জিয়াউর রহমান, এরশাদ এতে আরো বড় ভূমিকা রাখে। ঠিক এই সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করা হলো এটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে মোল্লাতন্ত্রে নিয়ে ফেলবে। চবি’র ভিসির দোয়া নেয়াটা মোল্লাতন্ত্রের একটা প্রতিচ্ছবি। ইরানের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাও খেমেনির পায়ের নিচে বসে দোয়া নেয়। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতাও যদি শফী হুজুর ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন সেটাকে আধুনিকতা বলা যাবে না, মোল্লাতন্ত্র নারীদের ফুটবলও খেলতে দিবে (যেমন ইরান) কিন্তু চেতনায় শাসন দন্ডে ইসলামিক ঝান্ডা উচিয়ে রাখবে। এখন যেমন একজন মহিলার নেতৃত্বকেও তারা মেনে নিচ্ছে। সময় মত এর জবাব দিতে এরা কেবল তৈরি হচ্ছে…।