জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় মন্দির থেকে মসজিদ। পাঠক আপনারা কি জানেন যে একসময় এই ভারতীয় উপমহাদেশে, ধর্মের হানাহানিতে খন্ডিত অংশ পাকিস্তানের এক প্রধান শহর করাচির নাম ছিল দেবল বা দেবালয় |
করাচির সুমুদ্র সৈকতে বিশাল একটি মন্দির ছিল । বহুদূর থেকে ওই মন্দিরের চূড়া দেখা যেত। ৭১২ খ্রষ্টাব্দে সেই মন্দিরকে মসজিদে রূপান্তির করে উপমহাদেশে ইসলামী বর্বরতার রক্তখেলা একরকমের শুরু করেছিল মহাম্মদ বিন কাশিম |
অনেক ইসলামী ঐতিহাসিকরা এটাকে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর মহান বিজয় বলে ব্যক্ত করেছে ! ইসলামিস্টদের মতে মন্দিরকে মসজিদে রুপান্তরের ব্যাপারটা খুব সোজা একটা প্রক্রিয়া |
১-মন্দিরের মূর্তিগুলোকে প্রথমে ভেঙে ফেলতে হবে | ২-আজান দেবার জন্য একটি মিনার তৈরী করতে হবে | ৩.খুতবা দেবার জন্য মিনার বানাতে হবে। ব্যাস, কেল্লাফতে !! জ্বলন্ত উধাহরণ হলো ভারতে আজমীরের ”আড়াই দিন কা ঝোপড়া’|
এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশে বিগত ১০০০ বছরে বহু হিন্দু পৌত্তলিক উপাসনালয় মসজিদে পরিনত হয়েছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আওরঙ্গজেবের দ্বারাকাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরা ও মথুরার কেশব মন্দির ভাঙা ও মসজিদে রূপান্তর করা |
আসলে পথ দেখিয়েছিল আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে এটি তার ধারাবাহিকতা মাত্র |
আবার অন্যদিকে আজকের বাংলাদেশে ঢাকার ওয়ারী এলাকার শিব-মন্দির ভেঙে ইসলামী বিদ্যালয় হয়েছে, টিপু সুলতান রোডের রাধ-কৃষ্ণের মন্দির হয়েছে মানিকগঞ্জ হাউজ !
বুন্দেলখন্ডের রাজা নরসিং দেব যুবরাজ সেলিমকে নানাভাবে সাহায্য করার পুরুষ্কার হিসেবে মথুরায় মন্দির নির্মান করার অনুমতি লাভ করেন এবং ৩৩ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ঐ বিশাল মন্দির নির্মান করেন।
আওরঙ্গজেবের আদেশে সেই মন্দিরকে ভেঙ্গে মসজিদ তৈরী করা হয়। এই প্রসঙ্গে ইসলামী কলমচি সাকি মুস্তাইদ খান উল্লসিত হয়ে লিখেছে:
‘ইনসাল্লা, ভাগ্যগুনে আমরা ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পেয়েছি। যে কর্ম সমাধা করা নিতান্ত দুঃসাধ্য ছিল, মেকি দেব দেবীর উপাসনালয় ধ্বংসকারী এই সম্রাটের রাজত্বে তাও সম্ভব হল।
সত্য ধর্মের প্রতি (সম্রাটের) এই বিপুল সমর্থন উদ্ধত হিন্দু রাজাদের চরম আঘাত হানলো পুতুল দেবতার মত তারাও তাদের ভয়ার্ত মুখ দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে রাখলো।’ ভাঙ্গা মন্দিরের মূর্তিগুলো নিয়ে সাকি মুস্তাইদ খান লিখল :
‘জংলী সেই সব মন্দির থেকে মূল্যবান রত্নখচিত সেই সব বিগ্রহ পাওয়া গেল সেগুলোকে আগ্রায় নিয়ে আসা হল এবং সেখানে নবাব বেগম সাহেবার মসজিদের সিড়ির নীচে ফেলে রাখা হল;
যাতে সত্য ধর্মে বিশ্বসীরা (মসজিদে যাওয়ার আসার সময়) সেগুলোকে চিরকাল পায়ের তলায় মাড়িয়ে যেতে পারে।’ তার লেখায় আরও পাই:
“রবিউল আখির মাসের ২৪ তারিখে খাঞ্জাহান বাহাদুর কয়েক গাড়ী হিন্দু বিগ্রহ নিয়ে যোধপুর ফেরলেন। সেখানকার অনেক মন্দির ভেঙে এ সব বিগ্রহ সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই কাজের জন্য মহামান্য সম্রাট তাকে খুবই প্রশংসা করলেন।
এই সব বিগ্রহের বেশীর ভাগই মূল্যন সোনা, রূপা, পিতল, তামা বা পাঠরের তৈরী ছিল। সম্রাটের হুকুম হল কিছু বিগ্রহ জঞ্জাল হিসেবে এখানে সেখানে ফেলে রাখতে যাতে বিশ্বাসীরা মসজিদে যাতায়তের সময় সেগুলোকে মাড়াতে পারে।”
পাথরের মূর্তি গুলোকে ভেঙে খোয়া করা হয়েছিল এবং সেই খোয়া দিয়ে জাম-ই-মসজিদের চাতাল মোজাইক করা হয়েছিল যাতে নামাজীরা এক অর্থে মূর্তিগুলোকে মাড়িয়ে নামাজ পড়তে যায় ! বিখ্যাত বিশ্বনাথ মন্দির এবং ১৬৭০ খৃষ্টাব্দে মথুরার বিখ্যাত কেশব রায় মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল।
দুটো মন্দিরের জায়গাতেই বিশাল দুই মসজিদ খাড়া করা হয়েছিল যা আজও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এবং যে কেউ কাশী বা মথুরা ভ্রমনে গেলে অনেক দূর থেকেই তা দেখতে পাবেন ! ([R.C.Majumder, BVB. Vol.VII,p-265) |
ঐতিহাসিক Dowson এক জায়গায় বলেছেন: “আমরা অবাক হব না যদি দেখি যে এই সব অত্যাচারী শাসকদের আমলে ন্যায় বিচার কলুষিত ও পক্ষপাত দুষ্ট অথবা যদি দেখি যে, অকথ্য নির্যাতন ও অত্যাচারের মধ্য দিয়ে সর্বত্র রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে।
গ্রামবাসীদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশেষ ভাবে পুরুষের পুরুষাঙ্গ ও মহিলাদের স্তন কেটে ফেলা হচ্ছে অথবা যদি দেখি, যে সব রাজকর্মচারীকে রক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারাই দূবৃর্ত্ত, ডাকাতের সর্দার বা উচ্ছেদকারী হানাদার রূপে অত্মপ্রকাশ করেছে।”
অপরদিকে যদি দেখেন পাঠক, তবে বলতে হয়, জালালউদ্দিন সিংহাসনে আরোহণ করে সূবর্ণ গ্রাম থেকে শেখ জহিরকে নিয়ে এসে তার উপদেশ অনুসারে রাজকার্য পরিচালনা শুরু করেন।
তিনি পূর্ববঙ্গে ইসলাম ধর্ম বিস্তারের জন্য ঘোষণা করলেন যে, সকলকে মুসলমান হতে হবে নয়তো প্রাণ দিতে হবে।
এই ঘোষনার পরে পূর্ববঙ্গের অনেকে কামরূপ আসাম ও কাছারের জঙ্গলে পালিয়ে যান। কিন্তু তথাকথিত নিন্মবর্ণের অনেক হিন্দুই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে।
ঐতিহাসিক রজনীকান্ত চক্রবর্তীর মতে, জালালউদ্দিনের ইসলাম ধর্ম প্রচারের ফলেই পূর্ব বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা এত বেশী। (সুত্র: গৌড়ের ইতিহাস, রজনীকান্ত চক্রবর্তী, পৃ-৪৫-৪৬) |
ভোজশালা– কামাল মৌলানা মসজিদ
মা সরস্বতীর এক অতি প্রাচীন মন্দির হল এই ভোজশালা। এই মন্দিরটির নির্মাণ করেন রাজা ভোজ যার রাজত্ব রাজস্থান থেকে উড়িষ্যা এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এটি মধ্যপ্রদেশের ধর জেলায় অবস্থিত যেটি রাজা ভোজয়ের রাজধানী ছিল।ভোজশালা ছিল হাজারো ছাত্র ও জ্ঞানী মানুষের সঙ্গমস্থল আর এটি শিক্ষা অর্জনের মুখ্য জায়গা ছিল।
ইসলামিক আক্রমণ শুরু হয় ৩৬ বছর আগেই যখন মৌলানা কামাল নামে একজন ফকির ১২৬৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মালওয়াতে প্রবেশ করেন। তিনি এখানে বহু মানুষকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন এবং দীর্ঘ ৩৬ বছর এখানকার সমস্ত খবর জোগাড় করে সেগুলি আলাউদ্দিন খিলজিকে দিয়ে দেন।
খ্রীষ্টপূর্ব ১৩০৫ সালে ভোজশালা সর্বপ্রথম আলাউদ্দিন খিলজি দ্বারা আক্রান্ত হয়। রাজা মহাকালদেব ও তাঁর সেনার পরাজয়ের পরে আলাউদ্দিন খিলজি ১২০০ হিন্দু ছাত্র ও শিক্ষককে হত্যা করেন কারণ তারা ধর্মান্তরিত হতে চায়নি।
একজন মুসলিম শাসক দিলাবার খান বিজয় মন্দির ( সূর্য মার্তন্ড মন্দির ) ধ্বংস করেন এবং সরস্বতী মন্দিরের একটি অংশকে দরগায় পরিণত করতে চান।
বর্তমানে মুসলিমরা এই বিজয় মন্দিরে নামাজ পাঠ করে এবং ষড়যন্ত্র করে এটিকে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে এটি আসলে একটি দরগা যার নাম হল “লাট মসজিদ “।আবারো মেহমুদ শাহ ভোজশালা আক্রমণ করেন এবং এটিকে দরগায় পরিণত করার চেষ্টা করেন।
তিনি সরস্বতী মন্দিরের বাইরের জমি জবরদখল করে সেখানে কামাল মৌলানার মৃত্যুর ২০৪ বছর পরে “কামাল মৌলানা মকবরা ” স্থাপন করেন।
১৯৯৭ সালের ১২ ই মার্চের পূর্বে হিন্দুদের দর্শন করার অনুমতি ছিল কিন্তু পুজা করার অনুমতি ছিল না।তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং এই নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বর্তমানে কেবলমাত্র বসন্ত পঞ্চমীর দিন ভোজশালায় হিন্দুদের প্রবেশাধিকার ও পুজো করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
এইগুলো সচেস্টভাবে লিখলে খুব সহজেই জুটতে পারে ‘চাডডি’ তকমা ! হাজার হলেও সুশীল সুধী ইসলামিস্ট এবং মডারেটগণ মুসলমান শাসনের যুগকে পরাধীনতার যুগ বলে কখনোই না দেখিয়ে বরং অখন্ড ভারতের ইতিহাসের স্বর্ণ যুগ হিসেবে দেখায় !
সুত্র:
- উইকিপিডিয়া|
- ‘বাংলার ইতিহাসের দুশো বছর’-সুখময় মুখোপাধ্যায় |
- ‘Hedayyah’-Translated by Charles Hamilton |
- ‘ইসলামী আইন তত্ত্বের উত্স’ -গাজী শামসুর রহমান |
- ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো |
- মন্দির থেকে মসজিদে (১ম ও ২য় খণ্ড). লেখক : মাওলানা কালিম সিদ্দিকী
আরো পড়ুন….