হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা: দাঙ্গা নাম দিয়ে হিন্দুর উপর নির্যাতনকে কিছুটা যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবী উত্থাপনের পর ১৯৪৬ সালের ১৬ থেকে ১৯ আগস্ট, মুসলমানরা পাকিস্তান আদায়ের জন্য কোলকাতায় ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে পালন ক’রে প্রায় ২০ হাজার অসহায় নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করে, হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ-ভাংচুর-লুঠপাট করে এবং অসংখ্য হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে।
হিন্দুদেরকে প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে বা প্রাণে বাঁচানোর লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরেরও চেষ্টা করে। এরপর মুসলমানদের আক্রমন শুরু হয় বৃহত্তর নোয়াখালিতে, সেখানে নৃশংসভাবে খুন করা হয় প্রায় ৫,০০০ হাজার হিন্দুকে, ধর্ষণ করা হয় ১২ থেকে ৪২ এর প্রায় সব হিন্দু মেয়েকে, হাজার হাজার হিন্দু নারী-পুরুষদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।
নানামুখী চাপে পড়ে অবশেষে জন্মভিটা থেকে বিতাড়িত হয় প্রায় বেশির ভাগ হিন্দু।প্রায় ৫০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ বেঁচে থাকা হতভাগ্যকে কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা ও অন্যান্য জায়গার অস্থায়ী আশ্রয় শিবির গুলোতে আশ্রয় দেয়া হয়
জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিতদের কাছ থেকে জোর করে লিখিত রাখা হয়েছিল যেখানে লেখা ছিল তারা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে বা ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হত এবং যখন কোন আনুষ্ঠানিক পরিদর্শক দল পরিদর্শনে আসত তখন তাদেরকে ওই নির্দিষ্ট বাড়িতে যাবার অনুমতি দেয়া হত।
হিন্দুদেরকে ওই সময় মুসলিম লীগকে চাঁদা দিতে হত যাকে বলা হত জিজিয়া[৬] (যা একসময় ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। মুসলিম শাসন আমলে হিন্দুরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তৎকালিন শাসকদের জিজিয়া নামক বাড়তি প্রদান করত।-সুত্র বাংলা উইকিপিডিয়া
হিন্দুদের এই রক্তপাতের উপর দেশ ভাগ হলো, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে প্রাণ গেলো প্রায় ২০ লাখ হিন্দু ও শিখের। ধর্ষিতা হলো প্রায় ১ লক্ষ মেয়ে, উদ্বাস্তু হলো কয়েক কোটি হিন্দু ও শিখ। কিন্তু এত কিছু করে এবং দেশ পেয়েও মুসলমানরা খুশি হলো না। তাদের আরও চাই, চাই বাকি হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, জমি-জমা সব কিছু। এজন্য হিন্দুদেরকে মারতে হবে, কাটতে হবে, মেয়েদেরকে ধর্ষণ করতে হবে, তাদেরকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে। পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের সংখ্যা যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে এনে ওদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে হবে।
পাাকিস্তানের এই পরিকল্পনা থেকেই শুরু হয়েছিলো ১৯৫০ এর হিন্দু বিতাড়ন। অনেকেই এটাকে বলে ১৯৫০ এর দাঙ্গা। কিন্ত তারা ভুলে যায় দাঙ্গা মানে দুই দলের মারামারি। এই ধরণের দাঙ্গা বাংলায় কখনো হয় নি।
এখানে যা হয়েছে তা সবসময়ই হিন্দু নির্যাতন। এর কারণ, ১৯৪৬ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দুরা শুধু মুসলমানদের হাতে মারই খেয়েছে, একজন মুসলমানকেও হিন্দুদের হাতে প্রাণ দিতে হয় নি বা মার খেতে হয় নি। তাই কোন যুক্তিতেই এই হিংসাগুলোকে দাঙ্গা বলা যায় না? প্রকৃতপক্ষে এসব ঘটনাকে দাঙ্গা নাম দিয়ে মুসলমানদের অত্যাচার নির্যাতনকে কিছুটা যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করা হয় মাত্র।
ব্যাপারটা এমন, ওরাও মেরেছে, আমরাও মেরেছি, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বাংলায় কখনো হিন্দু মুসলমান মারামারি হয় নি, মুসলমানরা সবসময়ই মেরেছে আর হিন্দুরা মার খেয়েছে।
অসহিষ্ণুতা শুরু হয়েছিলো ১৯৪৬ সাল থেকেই, আর এই অসহিষ্ণুতার বলি হয়েছিলো বৃহত্তর নোয়াখালি, কুমিল্লা ও ঢাকার হিন্দুরা।
পরবর্তী হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলো ‘৪৬ এর অসহিষ্ণুতারই সম্প্রসারিত রূপ মাত্র। অনেকেই ভেবেছিলো দেশ ভাগ হয়ে গেলে, মুসলমানরা নিজেদের একটি দেশ পেলে, এই সমস্যাগুলো এমনিই মিটে যাবে। কিন্তু যারা এটা ভাবতো, তাদের, মুসলমানদের মানসিকতা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না।
তাদের এই অজ্ঞানতার করণেই, বার বার, বাংলার হিন্দুদের হতে হয়েছে মুসলমানদের আক্রমনের শিকার এবং এখনও পর্যন্ত হতে হচ্ছে।
১৯৪৬ সালে, কোলকাতা ও নোয়াখালির পর, আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটানো হয় এই ১৯৫০ সালে।
‘৪৬ এর ঘটনা, ঘটানোর জন্য যেমন ১৯৪০ সাল থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিলো এবং ক্ষেত্র প্রস্তত করা হচ্ছিলো, ঠিক তেমনি, ১৯’৫০ সালের ঘটনা ঘটানোর জন্যও ১৯৪৮ সাল থেকে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে ঘটে নিচের এই ঘটনাটি গুলো ঃ-
বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার দীঘারকুল গ্রাম। একজন হিন্দু নদীতে মাছ ধরছিলো। সেই সময়, সেখানেই আর একজন মুসলমান নৌকা বেয়ে এসে তার সামনেই জাল ফেলার প্রস্তুতি নেয়।
এতে হিন্দুটি মুসলমানটাকে বাধা দেয় এবং তার মাছ ধরার স্থানে জাল ফেলতে নিষেধ করে। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
এতে এক আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করা মুসলমানটি মনে করে তার জেদ বজায় থাকছে না এবং এক হিন্দুর কাছে তার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিকটবর্তী মুসলমান গ্রামে গিয়ে ঐ মুসলমানটি রটিয়ে দেয় যে, হিন্দুরা, তার নৌকায় থাকা এক মুসলমান মহিলাকে আক্রমন করে অসম্মান করেছে।
ঐ সময় গোপালগঞ্জের এস.ডি.ও, নৌকাযোগে ওখান দিয়েই যাচ্ছিলো, এই অভিযোগটি তার কানেও যায় এবং সে কোনো রূপ তদন্ত না করে মুসলমান ব্যক্তির ঐ অভিযোগটিকে সত্য বলে ধরে নেয় এবং হিন্দুদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ওখানে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠায়। পুলিশ এলে স্থানীয় মুসলমানরাও পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে হিন্দুদের বাড়ী ঘরে হামলা করে এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে নির্মমভাবে প্রহার করার পর বাড়ীর সব মূল্যবান দ্রব্য লুট করে নিয়ে যায়।
এই নির্মম প্রহারের ফলে ঘটনাস্থলেই এক গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় হিন্দুদের উপর মুসলমানদের এই পৈশাচিক অত্যাচার বিশাল এলাকা জুড়ে হিন্দুদের মনে ভয়ংকর ত্রাস ও ভীতির সঞ্চার করে।
আরো পড়ুন….