হিন্দু গণহত্যা

হিন্দু গণহত্যা: ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ১ মাসে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়নের নৃশংস ইতিহাস

হিন্দু গণহত্যা: ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে ১ মাসে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়নের নৃশংস ইতিহাস।মুসলমানদের দ্বারা লিপিবদ্ধ ইতিহাসে বাংলাদেশ তথা পর্ববঙ্গের ইতিহাস শুরু হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে।

কিন্তু ১৯৪৭ এর পর থেকে ‘৫২ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে কী ঘটনা ঘটলো, কেনো এই ৫ বছরে পূর্ববঙ্গের হিন্দু ২৯% থেকে ২২% এ নেমে এলো, তার ইতিহাস আপনি কোথাও পাবেন না। কোনো মুসলমান, সেই ইতিহাস লিখবে না; কেননা, তাহলে তো আয়নায় নিজের মুখ দেখা হয়ে যায়।হিন্দু গণহত্যা

কিন্তু হিন্দুদের সেই ইতিহাস জানা দরকার। তাই অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে তুলে এনেছি সেই সব কাহিনী; যা জানলে আপনার গা শিউরে উঠবে, বুঝতে পারবেন আপনার প্রতিবেশি মুসলমানদের প্রকৃত চরিত্র। ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিলো সেই সব ঘটনা। কিন্তু শুরু করছি শুরু থেকেই….

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবী উত্থাপনের পর ১৯৪৬ সালের ১৬ থেকে ১৯ আগস্ট, মুসলমানরা পাকিস্তান আদায়ের জন্য কোলকাতায় ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে পালন ক’রে প্রায় ২০ হাজার অসহায় নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করে, হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি সংযোগ-ভাংচুর-লুঠপাট করে এবং অসংখ্য হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে; হিন্দুদেরকে প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে বা প্রাণে বাঁচানোর লোভ দিয়ে ধর্মান্তরেরও চেষ্টা করে। এরপর মুসলমানদের আক্রমন শুরু হয় বৃহত্তর নোয়াখালিতে, সেখানে নৃশংসভাবে খুন করা হয় প্রায় ১ হাজার হিন্দুকে, ধর্ষণ করা হয় ১২ থেকে ৪২ এর প্রায় সব হিন্দু মেয়েকে, জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হয় প্রায় সবাইকে। নানামুখী চাপে পড়ে অবশেষে জন্মভিটা থেকে বিতাড়িত হয় প্রায় বেশির ভাগ হিন্দু।হিন্দু গণহত্যা

 

হিন্দুদের এই রক্তপাতের উপর দেশ ভাগ হলো, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলিয়ে প্রাণ গেলো প্রায় ২০ লাখ হিন্দু ও শিখের, ধর্ষিতা হলো প্রায় ১ লক্ষ মেয়ে, উদ্বাস্তু হলো কয়েক কোটি হিন্দু ও শিখ। কিন্তু এত কিছু করে এবং দেশ পেয়েও মুসলমানরা খুশি হলো না। তাদের আরও চাই, চাই বাকি হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, জমি-জমা সব কিছু। এজন্য হিন্দুদেরকে মারতে হবে, কাটতে হবে, মেয়েদেরকে ধর্ষণ করতে হবে, তাদেরকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে; পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের সংখ্যা যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে এনে ওদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে হবে।

 

উপরের এই পরিকল্পনা থেকেই শুরু হয়েছিলো ১৯৫০ এর হিন্দু বিতাড়ন। অনেকেই এটাকে বলে ১৯৫০ এর দাঙ্গা। কিন্ত তারা ভুলে যায় দাঙ্গা মানে দুই দলের মারামারি। এই ধরণের দাঙ্গা বাংলায় কখনো হয় নি। এখানে যা হয়েছে তা সবসময়ই হিন্দু নির্যাতন।

এর কারণ, ১৯৪৬ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের হিন্দুরা শুধু মুসলমানদের হাতে মারই খেয়েছে, একজন মুসলমানকেও হিন্দুদের হাতে প্রাণ দিতে হয় নি বা মার খেতে হয় নি। তাই কোন যুক্তিতেই এই হিংসাগুলোকে দাঙ্গা বলা যায় না ? প্রকৃতপক্ষে এসব ঘটনাকে দাঙ্গা নাম দিয়ে মুসলমানদের অত্যাচার নির্যাতনকে কিছুটা যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করা হয় মাত্র। ব্যাপারটা এমন, ওরাও মেরেছে, আমরাও মেরেছি, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বাংলায় কখনো হিন্দু মুসলমান মারামারি হয় নি, মুসলমানরা সবসময়ই মেরেছে আর হিন্দুরা মার খেয়েছে।হিন্দু গণহত্যা

অসহিষ্ণুতা শুরু হয়েছিলো ১৯৪৬ সাল থেকেই, আর এই অসহিষ্ণুতার বলি হয়েছিলো বৃহত্তর নোয়াখালি, কুমিল্লা ও ঢাকার হিন্দুরা। পরবর্তী হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলো ‘৪৬ এর অসহিষ্ণুতারই সম্প্রসারিত রূপ মাত্র। অনেকেই ভেবেছিলো দেশ ভাগ হয়ে গেলে, মুসলমানরা নিজেদের একটি দেশ পেলে, এই সমস্যাগুলো এমনিই মিটে যাবে। কিন্তু যারা এটা ভাবতো, তাদের, মুসলমানদের মানসিকতা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না। তাদের এই অজ্ঞানতার করণেই, বার বার, বাংলার হিন্দুদের হতে হয়েছে মুসলমানদের আক্রমনের শিকার এবং এখনও হতে হচ্ছে।

 

বাংলাদেশে হিন্দু হত্যা
বাংলাদেশে হিন্দু হত্যা

১৯৪৬ সালে, কোলকাতা ও নোয়াখালির পর, আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটানো হয় এই ১৯৫০ সালে। ‘৪৬ এর ঘটনা, ঘটানোর জন্য যেমন ১৯৪০ সাল থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিলো এবং ক্ষেত্র প্রস্তত করা হচ্ছিলো, ঠিক তেমনি, ‘৫০ সালের ঘটনা ঘটানোর জন্যও ১৯৪৮ সাল থেকে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে ঘটে নিচের এই ঘটনাটি :

বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার দীঘারকুল গ্রাম। একজন হিন্দু নদীতে মাছ ধরছিলো। সেই সময়, সেখানেই আর একজন মুসলমান নৌকা বেয়ে এসে তার সামনেই জাল ফেলার প্রস্তুতি নেয়। এতে হিন্দুটি মুসলমানটাকে বাধা দেয় এবং তার মাছ ধরার স্থানে জাল ফেলতে নিষেধ করে। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।

এতে এক আল্লা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত না করা মুসলমানটি মনে করে তার জেদ বজায় থাকছে না এবং এক হিন্দুর কাছে তার মাথা নত হয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিকটবর্তী মুসলমান গ্রামে গিয়ে ঐ মুসলমানটি রটিয়ে দেয় যে, হিন্দুরা, তার নৌকায় থাকা এক মুসলমান মহিলাকে আক্রমন করে অসম্মান করেছে।হিন্দু গণহত্যা

ঐ সময় গোপালগঞ্জের এস.ডি.ও, নৌকাযোগে ওখান দিয়েই যাচ্ছিলো, এই অভিযোগটি তার কানেও যায় এবং সে কোনো রূপ তদন্ত না করে মুসলমান ব্যক্তির ঐ অভিযোগটিকে সত্য বলে ধরে নেয় এবং হিন্দুদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ওখানে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠায়। পুলিশ এলে স্থানীয় মুসলমানরাও পুলিশের সাথে যোগ দিয়ে হিন্দুদের বাড়ী ঘরে হামলা করে এবং নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে নির্মমভাবে প্রহার করার পর বাড়ীর সব মূল্যবান দ্রব্য লুট করে নিয়ে যায়।

এই নির্মম প্রহারের ফলে ঘটনাস্থলেই এক গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত ঘটে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় হিন্দুদের উপর মুসলমানদের এই পৈশাচিক অত্যাচার বিশাল এলাকা জুড়ে হিন্দুদের মনে ভয়ংকর ত্রাস ও ভীতির সঞ্চার করে।

এর পরের ঘটনাটি ঘটে বরিশাল জেলার গৌরনদী থানায়। এখানকার ইউনিয়ন বোর্ডে, হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটি সমস্যা হয়। এর মধ্যে কিছু হিন্দু ছিলো কমিউনিস্ট সমর্থক, যে কমিউনিস্টরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষেই ছিলো। কিন্তু কমিউনিজম তো ইসলাম তথা মুসলমানদের চিরশত্রু, তাই পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই শুরু হয়েছিলো পূর্ববঙ্গ থেকে কমিউনিস্টদের বিতাড়ন। মুসলমানদের এই তাড়া খেয়েই পূর্ববঙ্গের সব হিন্দু কমিউনিস্ট পশ্চিমবঙ্গে হিজরত করে এবং পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয় বামেদের রমরমা।হিন্দু গণহত্যা

যা হোক, ওখানে হিন্দুদেরকে শায়েস্তা করার জন্য এই কমিউনিস্ট সূত্রকেই কাজে লাগানো হয়। গৌরনদী থানার উপর কমিউনিস্টরা আক্রমন করতে পারে এই গুজব ছড়িয়ে চারেদিকে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয় এবং বরিশাল সদর থেকে গৌরনদী থানায় সশস্ত্র বাহিনী পাঠানো হয়।

 

তারা ঐ অঞ্চলের বহু হিন্দু বাড়ী লুঠ করে মূল্যবান জিনিস পত্র নিয়ে চলে যায়। এমনকি যেসব বাড়ির মালিক কমিউনিস্ট হওয়া তো দূরের কথা, রাজনীতিও করে না, এমনকি বাড়িতেও থাকে না, সে সব বাড়িও আক্রমন করে লুঠ করা হয়। এছাড়াও ঐ অঞ্চলের বহু হিন্দুকে গ্রেফতার করা হয় এবং স্কুল কলেজের বহু হিন্দু ছাত্র-শিক্ষককেও কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে অযথাই হয়রানি করা হয়। এ ব্যাপারে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে লিখিত আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পান নি।

 

এরপর বৃহত্তর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমায় আর একটি ঘটনা ঘটানো হয়। তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মুসলমান ও পুলিশ মিলে হিন্দুদের বাড়ী-ঘরে হামলা করে মূল্যবান জিনিসপত্র লুঠ করে নিয়ে যায় এবং এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মিলিটারী চৌকি বসানো হয়। এই মিলিটারি চৌকিতে খাবার সরবরাহ করতে বাধ্য করা হয় এলাকার হিন্দুদের; শুধু তাই নয়, রাতের বেলা হিন্দু মেয়েদেরকেও ক্যাম্পে পাঠাতে বাধ্য করতো মিলিটারীরা।

এরপর ঘটে রাজশাহী জেলার নাচোলের ইলা মিত্রের সেই বিখ্যাত ঘটনা। যেখানে কমিউনিস্টি দমনের নাম পুলিশের সাথে স্থানীয় মুসলমানরা মিলে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করে এবং তাদের সম্পত্তি লুঠ করে। এরপর ওখানকার সাঁওতালরা সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়।হিন্দু গণহত্যা

 

১৯৪৯ সালের ২০ ডিসেম্বর, খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার মোল্লারহাট থানার কালশিরা গ্রামে মুসলমানরা ঘটায় আর একটি ভয়ংকর ঘটনা। কালশিরা থেকে তিন মাইল দূরে ঝালরডাঙ্গা গ্রামে, কমিউনিস্টদের খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ এক অভিযান চালায়। ফলে এই গ্রাম থেকে কিছু যুবক পালিয়ে গিয়ে কালশিরা গ্রামে জনৈক জয়দেব ব্রহ্মের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। শেষরাতে পুলিশ জয়দেবের বাড়িতেও হানা দেয়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে যুবকরা আবার পালিয়ে যায়।

পুলিশ কাউকে না পেয়ে জয়দেবের স্ত্রীকে মারতে শুরু করে। জয়দেবের স্ত্রীর চিৎকার শুনে ঐ যুবকরা আবার বাড়ি ফিরে আসে এবং উল্টো পুলিশকেই মার দিতে শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ মারা যায় এবং অন্যরা আহত হয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ খুন হওয়ায় জয়দেব এবং তার কিছু প্রতিবেশি ঘটনা আঁচ করতে পেরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং অন্য সাধারণ গ্রামবাসী, যারা নিজেদেরকে নির্দোষ মনে করেছিলো, তারা গ্রামেই রয়ে যায়।

পরদিন বিকালে খুলনার পুলিশ সুপার একদল সৈন্য এবং সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে ঐ গ্রামে যায় এবং সবাই মিলে গ্রামের হিন্দুদের পাইকারিদরে প্রহার করা শুরু করে এবং প্রতিবেশি মুসলমানদেরকে হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠ করে নিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। এতে লুঠ হয় হিন্দুদের সম্পত্তি, মারা যায় বেশ কয়েক জন হিন্দু, অনেক নারী ও পুরুষকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়, মন্দিরের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং নানা উপায়ে মন্দিরকে অপবিত্র করা হয়। পুলিশ মিলিটারী এবং স্থানীয় মুসলমানরা অনেক হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করে।

 

১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, এই গ্রামটি পরিদর্শনে যান, পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। তিনি গিয়ে দেখেন, গ্রামটি জনশুন্য ও বিধ্বস্ত; ৩৫০টি বাড়ির মধ্যে মাত্র ৩টি বাড়ি অক্ষত অবস্থায় আছে, বাকি সব বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।হিন্দু গণহত্যা

হিন্দুদের নৌকা, গরু-ছাগল সব লুঠ করে নেওয়া হয়েছে। কালশিরার এই সব অত্যাচারিত, গৃহহীন হিন্দুরা এক দিনে পথের ভিখিরিতে পরিণত হয়ে কোলকাতায় পালিয়ে আসে এবং অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এবং তাদের এইসব কাহিনী সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে পশ্চিমঙ্গেও কিছু সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই সাম্প্রাদায়িক উত্তেজনার খবর পূর্ববঙ্গের পত্রিকাগুলিতে অতিরঞ্জিত করে ছাপানো হয়, যদিও পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর পুলিশ-মুসলমানের যৌথ আক্রমনের সময় পত্রিকাগুলো চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো।

কালশিরা ও নাচোলের ঘটনার জন্য পূর্ববঙ্গ বিধানসভার হিন্দু বিধায়করা সংসদে একটি প্রস্তাব এনে আলোচনা করতে চান, কিন্তু সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া হয়, এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হিন্দু বিধায়করা সংসদ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসে। হিন্দু সাংসদদের এই ওয়াক আউটে, মুসলিম লীগ সরকার বেশ ভালো রকম রুষ্ট হয় এবং ১৯৪৬ সালের পর হিন্দুদেরকে আরেকবার শায়েস্তা করার জন্য প্ল্যান তৈরি করে ফেলে।

কোলকাতার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে পূর্বববেঙ্গর পত্রিকাগুলোর অপপ্রচার এবং উস্কানি তো ছিলোই, এর সাথে ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ঘটানো হয় আরেক ঘটনা; যা মুসলমানদেরকে, হিন্দুদের আক্রমন করতে উস্কানি দেয়; ঘটনাটি এরকম:

 

একজন মহিলার কাপড়ে লাল রং মাখিয়ে তাকে ঢাকার সচিবালয়ে ঘোরানো হয় এবং প্রচার করা হয় যে, ঐ মহিলার দুটি স্তন কোলকাতার হিন্দুরা কেটে নিয়েছে। এই প্রচারণায় বিশ্বাস করে সচিবালয়ের সমস্ত মুসলিম কর্মচারী কাজ ফেলে হিন্দুদের উপর বদলা নেওয়ার জন্য শ্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।হিন্দু গণহত্যা

অথচ নির্বোধ মুসলমানরা এটা চিন্তা করে দেখলো না, কোলকাতায় কারো স্তন কেটে নিলে তার পক্ষে সুস্থ ভাবে ঢাকায় এসে হাঁটা সম্ভব নয় এবং তা থেকে তাজা রক্ত ঝরাও সম্ভব নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার এত উন্নতির পরে কোলকাতা-ঢাকার বাস দূরত্ব প্রায় ৮ঘন্টার; ১৯৫০ এ এটা ছিলো প্রায় ২৪ ঘন্টার। তাহলে কোলকাতায় স্তন কেটে নিলে কিভাবে কারো স্তন থেকে ২৪ ঘন্টা পরও তাজা রক্ত ঝরে ?

কিন্তু কথায় আছে, দূরাত্মার ছলের অভাব হয় না। মুসলমানদেরও হয় নি, সচিবালয় থেকে শুরু হওয়া হিন্দু বিরোধী মিছিল বড় হতে হতে প্রায় ১ মাইল দীর্ঘ হয় এবং তা ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে দুপুর ১২টায় একটি বিশাল জনসভায় রূপ নেয়। ঐ জনসভায় মুসলিম লীগের নেতারা হিন্দু বিরোধী বক্তব্য দিয়ে উপস্থিত মুসলমানদেরকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আরো ক্ষেপিয়ে তুলে এবং জনসভা শেষ হতে না হতেই পুরো ঢাকা শহরে হিন্দুদের উপর আক্রমন শুরু হয়ে যায়।হিন্দু গণহত্যা

শহরের সবখানেই হিন্দুদের ঘর-বাড়ি ও দোকানে অগ্নি সংযাগ ও লুঠপাট শুরু হলো। যে যেখানে পেলো, সেখানেই হিন্দুদেরকে খুন করতে লাগলো। উচ্চপদস্থসহ সকল পুলিশ কর্মকর্তারা এই লুটতরাজ, খুন, অগ্নিসংযোগকে শুধু নীরব দর্শকের মতোই দেখলো না, তারা দাঙ্গাকারীদেরকে বুদ্ধি দিয়ে, কৌশল শিখিয়ে এইসব কাজে মুসলমানদেরকে আরও উৎসাহ দিতে লাগলো।

 

পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এই দিন করাচী থেকে ঢাকায় পৌঁছেন এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেন।

১১ ফেব্রুয়ারি তিনি পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে হিন্দুদেরকে রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন, কিন্তু তার কথায় কোনো কর্ণপাত করা হয় নি। উল্টো হিন্দু নির্যাতন চলতেই থাকে। এই সময় সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “ঢাকায় ৯ দিন অবস্থানকালে আমি ঢাকা ও তার পার্শ্ববতী এলাকার প্রায় সব দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করি। ঢাকা-নারায়নগঞ্জ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে শত শত নিরপরাধ হিন্দুর হত্যালীলার সংবাদ আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে।”হিন্দু গণহত্যা

 

ইসলামের জিহাদ সবসময়ই একটি লাভজনক ব্যাপার। কারণ, এর সাথে গনিমতের মাল অর্থাৎ লুঠের সম্পত্তির বিষয়টি জড়িত। ঢাকায় যখন হিন্দুদের উপর এসব হত্যালীলা, অগ্নি সংযোগ ও তাদের ধন-সম্পত্তি লুঠ চলছে এবং এভাবে ঢাকার মুসলমানরা লাভবান হচ্ছে, তখন বরিশালের মুসলমানরা এই লাভ থেকে পিছিয়ে থাকবে কেনো ? তাই বরিশালেও ঘটানো হয় আরেক ঘটনা।

সেই সময় মুসলিম লীগের আরেক নেতা এবং পাকিস্তান আদায়ের এক বলিষ্ঠ নায়ক এ. কে. ফজলুল হক, কোলকাতায় তার ঝাউতলা রোডের বাড়ি বিক্রি করার জন্য কোলকাতায় অবস্থান করছিলো। হিন্দুদের উপর মার এবং লুঠপাট তো শুরু করতে হবে, কিন্তু এর জন্য তো একটা ইস্যু দরকার।

 

বরিশাল শহরে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হলো যে, কোলকাতায় হক সাহেবকে হিন্দুরা খুন করে ফেলেছে। রং মাখানো কাপড়কে যে মুসলমানরা স্তন কাটা রক্ত ধরে নিয়ে ঢাকা এবং তার আশে পাশের শহরে হাজার হাজার হিন্দুকে খুন করতে পারে, তাদের সম্পত্তি লুঠ করতে পারে, বাড়ি-ঘর দোকানে আগুন দিতে পারে, মেয়েদের ধর্ষণ করতে পারে, সেই মুসলমানদের কাছে হক সাহেব বেঁচে আছে, না সত্যিই মারা গেছে, তার সঠিক তথ্যের তো কোনো দরকার নাই।হিন্দু গণহত্যা

তাই শুরু হয়ে গেলো বর্তমানের বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালি ও পিরোজপুর, বরগুনা জেলায় খুন-ধর্ষণ- অগ্নি সংযোগ এবং এর সাথে লুঠপাট। এই চার জেলায় খুন করা হলো প্রায় ৭ হাজার হিন্দুকে। এর সাথে ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুঠপাটের বিষয়টি কল্পনা করে নিন।

 

ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে হত্যা-ধর্ষণ-লুঠ-অগ্নিসংযোগ আগে থেকেই চলছিলো, বরিশালের সাথে সাথে তা আবারও সম্প্রসারিত হয় কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালি,সিলেট, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর জেলায়। এই সবগুলো জেলা মিলিয়ে ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারি মাসেই খুন করা হয় প্রায় ৫০ হাজার হিন্দুকে। আবারও অনুরোধ করবো, এর সাথে ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-লুঠপাট এবং ধর্মান্তরের চেষ্টাকে কল্পনা করে নিতে।হিন্দু গণহত্যা

বরিশাল শহরের এরকম পরিস্থিতির খবর পেয়ে বাড়ি বিক্রি করা বন্ধ রেখে ফজলুল হক, তড়ি ঘড়ি করে বরিশাল ফিরে এবং শহরে ও তার আশে পাশে ১৬ টি জায়গায় জনসভা করে বলে, “তোমরা দেইখ্যা যাও, আমি মরি নাই। কিন্তু তোমরা এইটা কী করলা ?” কিন্তু কে শোনে কার কথা ? জিহাদের সময় মুসলমানদের কাছে কোরান পোড়ানোও ফরজ। এটা আমি বলছি না, ২০১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় কোরান পোড়ানোর সময় এই যুক্তিই দিয়েছিলো।

 

তাই ঐ সময় ফজলুল হকের কথা শুনে এ্যাকশন বন্ধ করার চেয়ে হিন্দুদের মেরে লুঠের মাল হস্তগত করা ছিলো নীতিহীন মুসলমানদের কাছে বেশি জরুরী। এজন্য ফজলুল হক স্বশরীরে বরিশালে উপস্থিত হয়েও হিন্দুদেরকে হত্যা করা থেকে মুসলমানদেরকে নিরস্ত করতে পারে নি। যদিও এই সময় হিন্দু হত্যা বন্ধে তার ফজলুল হকের সদিচ্ছা ছিলো, এজন্য সে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।হিন্দু গণহত্যা

কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, হক ছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির একজন একনিষ্ঠ সমর্থক, যে পাকিস্তানের জন্যই হিন্দুদের এত রক্ত ঝরিয়েছিলো মুসলমানরা। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ফজলুল হকই প্রথম পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবী তোলে; ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর, সে ছিলো একজন নীরব সমর্থক এবং ১৯৪৬ সালে নোয়াখালির ঘটনায় যে দু’ চারজন মুসলমানকে এ্যারেস্ট করা হয়েছিলো, ফজলুল হক তাদেরকে ছেড়ে দেবার জন্য সুপারিশ করেছিলো।

 

যা হোক, বরিশালের এই সংবাদ পেয়ে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, ঢাকা থেকে বরিশাল যান। সেখানাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “ইং ২০ ফেব্রুয়ারি, (১৯৫০) আমি বরিশাল পৌঁছলাম এবং সেখানকার দাঙ্গার ঘটনাবলী শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই জেলার শহরে প্রচুর হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অনেক হিন্দুকে খুন করা হয়েছে।

এই জেলার প্রত্যেকটা দাঙ্গা-বিধস্ত এলাকা আমি পরিদর্শন করি। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, কী করে জেলা শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল পরিধির মধ্যে মোটর রাস্তা দ্বারা কাশীপুর মাধব পাশা এবং লাখুটিয়ার মতো স্থানেও মুসলিম দাঙ্গাবাজরা বিভৎস তাণ্ডব সৃষ্টি করতে পারে। মাধব পাশার জমিদার বাড়িতে প্রায় ২০০ জনকে হত্যা ও ৪০ জনকে আহত করা হয়। মুলাদী নামক একটি স্থানে নরকের বিভীষিকা নামিয়ে আনা হয়। একমাত্র মুলাদীতেই ৩০০ জনের বেশি লোককে খুন করা হয়েছে।হিন্দু গণহত্যা

 

মুলাদী গ্রাম পরিদর্শন কালে আমি স্থানে স্থানে মৃত ব্যাক্তিদের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। দেখলাম নদীর ধারে কুকুর-শকুনেরা মৃতদেহগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমি জানতে পারলাম, সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে পাইকারি হারে খুন করার পর- সব যুবতী নারীকে মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। রাজাপুর থানার অন্তর্গত কৈবর্তখালি গ্রামে ৬৩ জনকে একদিনে হত্যা করা হয়। ঐ থানা অফিসের কাছেই অবস্থিত হিন্দু বাড়িগুলি লুট করে জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে কেটে ফেলা হয়। বাবুগঞ্জ বাজারের সমস্ত হিন্দুর দোকান প্রথমে লুঠ করে পরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

বিস্তারিত বিবরণ যা এসেছে, তা থেকে খুব কম করে ধরলেও একমাত্র বরিশাল জেলাতেই খুন করা হয়েছে ১০ হাজার হিন্দুকে। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের দাঙ্গার বলির সংখ্যা মোট ৫০ হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। গভীর দুঃখে আমি কাতর হয়ে পড়লাম। প্রিয়-পরিজন হারানো, স্বজন হারানো নারী-পুরুষ ও শিশুদের সব হারানো কান্না-বেদনা-বিলাপে আমার ভগ্ন হৃদয় হাহাকার করে উঠলো। আমি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, “ইসলামের নামে কী আসছে পাকিস্তানে ?”হিন্দু গণহত্যা

 

আমাদের পাশে থাকতে একটি লাইক দিয়ে রাখুন।-ধন্যবাদ

আর পড়ুন….