মার্কিন শুল্ক: বাণিজ্য যুদ্ধের আড়ালে নতুন পরাশক্তির উত্থান? ভারত-মার্কিন সংঘাতের নেপথ্যের খেলা! কয়েক বছর আগের “হাউডি মোদী”-র উষ্ণতা থেকে সরাসরি বাণিজ্য সংঘাত! ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক এক নাটকীয় মোড় নিয়েছে, যা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আমেরিকার পক্ষ থেকে ভারতের ওপর ৫০% শুল্ক আরোপ এবং তার জবাবে ভারতের চাল রপ্তানি বন্ধের মতো কঠোর পদক্ষেপ—এই ঘটনাগুলো কি শুধুই একটি বাণিজ্য যুদ্ধ, নাকি এর আড়ালে ক্ষমতার ভারসাম্যে এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে?
এই সংঘাতের গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায়, এটি সাধারণ অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এর সাথে জড়িয়ে আছে ভূ-রাজনীতি, কৌশলগত চাপ এবং এক নতুন, আত্মবিশ্বাসী ভারতের উত্থানের গল্প।
মার্কিন শুল্ক: ঘোষিত কারণ বনাম আসল উদ্দেশ্য
আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের ওপর দুই ধাপে মোট ৫০% শুল্ক আরোপ করার পেছনে যে কারণটি দেখিয়েছে, তা হলো ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনা। তাদের যুক্তি, এই তেল কেনার মাধ্যমে ভারত পরোক্ষভাবে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অর্থায়ন করছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি একটি ঘোষিত কারণ মাত্র। এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর কিছু উদ্দেশ্য:
-
ভূ-রাজনৈতিক চাপ: আমেরিকা চাইছে ভারত যেন পুরোপুরি पश्चिमी শিবিরের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং রাশিয়া ও চীনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসে। এই শুল্ক আরোপ সেই চাপের একটি অংশ।
-
ব্যক্তিগত অসন্তোষ: বাণিজ্য আলোচনায় ভারতের কঠোর অবস্থান, বিশেষ করে কৃষি ও ডেয়ারি খাতে ছাড় না দেওয়া এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রত্যাশা মতো সমর্থন না পাওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যক্তিগত অসন্তোষও একটি বড় কারণ হতে পারে।
-
দ্বৈতনীতি: মজার বিষয় হলো, চীন রাশিয়ার তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা হওয়া সত্ত্বেও তাদের ওপর এমন কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই দ্বৈতনীতি প্রমাণ করে যে, আমেরিকার আসল উদ্দেশ্য শুধু তেল কেনা বন্ধ করা নয়, বরং ভারতকে একটি নির্দিষ্ট পথে চালনা করা।
মার্কিন শুল্ক: নীরবতা ভেঙে শক্তিশালী জবাব
অতীতে ভারত সাধারণত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রক্ষনাত্মক নীতি গ্রহণ করত। কিন্তু এবার চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুল্কের জবাবে ভারত যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তা এক নতুন ভারতের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছে:
-
চাল রপ্তানি বন্ধ: ভারত আমেরিকায় সব ধরনের চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। এর ফলে আমেরিকার বাজারে কয়েক বিলিয়ন ডলারের শূন্যতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি সরবরাহে সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
-
অর্থনৈতিক অস্ত্রের ব্যবহার: ভারত এখানেই থেমে থাকেনি। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, শুল্ক প্রত্যাহার না হলে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের মশলা, সামুদ্রিক পণ্য, হস্তশিল্প এবং আয়ুর্বেদিক পণ্যের রপ্তানিও বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। এর মাধ্যমে ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তার বিশাল বাজার এবং খাদ্য ভান্ডারকে সে একটি কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত।
কৌশলগত দ্বৈতনীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধ্যবাধকতা
আমেরিকার এই দ্বৈতনীতির পেছনেও রয়েছে কৌশলগত কারণ। চীনের হাতে রয়েছে গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল, যা আমেরিকার প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তি শিল্পের জন্য অপরিহার্য। তাই চীনের ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করা আমেরিকার জন্য কঠিন। অন্যদিকে, ভারতের এই কঠোর অবস্থানের পেছনেও রয়েছে তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধ্যবাধকতা।
সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের পর ভারতের পক্ষে কৃষি বা ডেয়ারি খাতে আমেরিকার কাছে মাথা নত করা রাজনৈতিকভাবে প্রায় অসম্ভব। সরকার বুঝতে পারছে যে, দেশের কৃষকদের স্বার্থ উপেক্ষা করে কোনো আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করলে তার রাজনৈতিক মূল্য অনেক বেশি হবে। সুতরাং, ভারতের এই পাল্টা চাল শুধু একটি বিদেশ নীতির অংশ নয়, এটি তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিরও প্রতিফলন।

মার্কিন শুল্ক:ভারত-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ভারতের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি
ভারতের এই নির্ভীক পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে কাজ করছে তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার, স্থিতিশীল রুপি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর তুলনায় জিডিপিতে বাণিজ্যের তুলনামূলক কম অংশ—এই বিষয়গুলো ভারতকে একটি অর্থনৈতিক সুরক্ষা কবচ প্রদান করেছে। এই আর্থিক শক্তিই ভারতকে আমেরিকার মতো একটি পরাশক্তির চাপের মুখে দাঁড়িয়ে নিজস্ব শর্তে আলোচনা করার সাহস জোগাচ্ছে। এটি প্রমাণ করে, ভারতের আত্মবিশ্বাস শুধু রাজনৈতিক নয়, এর ভিত্তি অর্থনৈতিকভাবেও যথেষ্ট মজবুত। ভারত-মার্কিন-বাণিজ্য-যুদ
মার্কিন শুল্ক : এক নতুন পরাশক্তির পদধ্বনি?
ভারত-মার্কিন এই বাণিজ্য যুদ্ধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি এক পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতিফলন, যেখানে ভারত আর শুধু একটি উদীয়মান অর্থনীতি নয়, বরং একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। অর্থনৈতিক শক্তিকে বিদেশ নীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এই নতুন কৌশল ভারতকে কি আগামী দিনে এক নতুন পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত করে তুলবে? এই প্রশ্নটিই এখন বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়।