ব্রহ্ম কাল গণনা : সনাতন ধর্ম অনুসারে, আমরা সময়ের কোন স্তরে আছি? হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ৮৬৪ কোটি বছর পরপর ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও ধ্বংস হয় এবং এই প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতে থাকে।
প্রতিটি মহাবিশ্ব ৪.৩২ বিলিয়ন বছর সময়কাল ধরে স্থায়ী হয়। এই সময়কালকে এক কল্প বা ব্রহ্মার এক দিন বলা হয়। এক কল্পের সমান সময়কাল পরে আসে ব্রহ্মাণ্ডের প্রলয় বা রাত।
পৃথিবীর বসয় কত? হিন্দুধর্ম মতে, আমরা সময়ের কোন স্তরে আছি? বর্তমানে, ব্রহ্মার পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে। যেহেতু, ব্রাহ্মার পঞ্চাশ বছর পার হয়েছে, এটি দ্বিতীয় পরার্ধ। (ব্রহ্মার ৫০ বছর = ১ পরার্ধ)
ব্রহ্মার এর আগের দিনের নাম ছিল পদ্ম কল্প। এটি ব্রহ্মার ৫১তম বর্ষের প্রথম দিন। এই দিনের নাম শ্রী শ্বেত বরাহ কল্প।
[মার্কণ্ডেয় পুরাণ]
এই কল্পের ১৪ মন্বন্তরের মধ্যে ৬ মন্বন্তর পার হয়েছে। এটি ৭ম মন্বন্তর, নাম বৈবস্বাৎ মন্বন্তর।
এই মন্বন্তরের ২৭টি মহাযুগ এবং ২৮ তম মহাযুগের সত্য, ত্রেতা এবং দ্বাপর যুগ পার হয়ে, কলিযুগ চলছে।
কলিযুগ শুরু হয়েছে মহাভারতের যুগের শেষে, ৩১০২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।
৩১৪০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের মাঘ মাসের পূর্ণিমায় (শুক্রবার) কলিযুগের উৎপত্তি ঘটে (যার ৪ দিন আগে ভীষ্ম দেহত্যাগ করে) এবং কার্যকরী ভাবে দেখা দেয় ৩৭ বছর পরে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর পরের দিন, ৩১০২ খ্রীস্টপূর্বাাব্দের চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে (বসন্ত নবরাত্রির প্রথম দিনে/ বিক্রমসম্বতের পহেলা দিন (চান্দ্র পহেলা চৈত্র)/ বাসন্তী পূজার প্রতিপদের দিন)। অর্থাৎ, কলিযুগের ৪৩২,০০০ বছরের মধ্যে ৫১২০ বছর পার হয়েছে। (সন ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে)ব্রহ্ম কাল গণনা
তো দেখা যাক, কতবছর পার হয়েছে এবং কালের কোন স্থরে আমরা আছি।
সময় গণনা
বিভিন্ন গ্রন্থের থেকে সময় কিছুটা এমন পাওয়া যায়।
১. ব্রহ্ম কাল
সবার প্রথমে আসে, পুরুষ ও প্রকৃতি। পুরুষ মহাবিষ্ণু বা কারণোদকস্য বিষ্ণু।তিনি অনাদি-অনন্ত। তার মধ্যে থাকে প্রকৃতি। এবং তাদের মধ্যে থেকেই সৃষ্টি হয়েছে হিরণ্যগর্ভ (ব্রহ্মাণ্ড/ মহাবিশ্ব)।
[আমি এখানে সৃষ্টি রহস্য বর্ণনা করছি না, কারণ এতে বিষয় ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে]
এটিই একমাত্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নয়, এটি ছাড়াও আরও হাজারো ব্রহ্মাণ্ড আছে। এটি সেই হাজারো ব্রহ্মাণ্ডের একটি। প্রত্যেক ব্রহ্মাণ্ডের একজনই ব্রহ্মা থাকে। তার জন্ম হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডিয় বিষ্ণ বা ক্ষীরোদকস্য বিষ্ণু হতে। ব্রহ্মার যেমন জন্ম আছে তেমনি মৃত্যুও আছে। এই পর্যন্ত ব্রহ্মা ৬ বার জন্মগ্রহণ করে মৃত্যু বরণ করেছেন। এটি সপ্তম ব্রহ্মার সময় চলছে। এই ব্রহ্মাণ্ডের ব্রহ্মাদের নাম -ব্রহ্ম কাল গণনা
১. বিরিঞ্চি প্রজাপতি
২. পদ্মভূ প্রজাপতি
৩. স্বয়ম্ভূ প্রজাপতি
৪. পরমেষ্ঠী প্রজাপতি
৫. সুরজেষ্ঠ প্রজাপতি
৬. হেমাগর্ভ প্রজাপতি
৭. সতানন্দ প্রজাপতি (বর্তমান ব্রহ্মা)
৮. চতুর্মুখ প্রজাপতি
৯. হনুমান প্রজাপতি (সহ আরো অনেক)
যদি পুজার সময় ঠিক মতো মনোযোগ দিয়ে থাকেন তাহলে পূজা সংকল্প কালে এই চরণ গুলো শুনে থাকবেন –
” ॐ বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ বিষ্ণুঃ ॐ
শ্রী গোবিন্দ গোবিন্দ মহাপুরুষস্য
বিষ্ণুরাজ্ঞায়া প্রাবর্তমানস্য
অদ্যব্রহ্মণঃ দ্বিতীয় পরার্ধে
শ্রী শ্বেত বরাহ কল্পে বৈবস্বাত মন্বন্তরে
অষ্টাবিংশতমে যুগে কলিযুগে কলি প্রথম চরণে….”
[শুধু প্রয়োজনীয় অংশ লেখা হয়েছে ]
এবার দেখুন অদ্যব্রহ্মণঃ ব্রহ্ম কাল গণনা অর্থাৎ বর্তমান ব্রহ্মার সময় কালে, দ্বিতীয়পরার্ধে অর্থাৎ ৫০ বছর পরে (৫১তম বর্ষে), শ্রী শ্বেত বরাহ কল্পে অর্থাৎ ব্রহ্মার এই দিনের নাম শ্রী শ্বেত বরাহ কল্প, বৈবস্বাত মন্বন্তরে মানে বৈবস্বাত মনুর সময় কালে, অষ্টাবিংশতমে যুগে মানে ২৮ তম মহাযুগে, কলিযুগে অর্থাৎ এই মহাযুগের কলি কালে, কলিপ্রথম চরণে মানে কলিযুগের প্রথম ভাগে…..
তো এখানে সময়ের স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়।
কিছু তথ্য –
১. ১ ব্রহ্মা আয়ু = ১০০ ব্রহ্ম বর্ষ
২. ১ ব্রহ্ম বর্ষ = ৩৬০ ব্রহ্ম অহোরাত্রি
৩. ১ ব্রহ্ম অহোরাত্রি = ১ ব্রহ্ম দিবস + ১ ব্রহ্ম রাত্রি = ২ কল্প [১ ব্রহ্ম দিবস = ১ ব্রহ্ম রাত্রি = ১ কল্প]
৪. ১ কল্প =১০০০ মহাযুগ
৫. ১ মহাযুগ (চতুর্যুগ) = ৪,৩২০,০০০ বছর = সত্য যুগের ৪ × ৪৩২,০০০ বছর + ত্রেতা যুগের ৩ × ৪৩২,০০০ বছর + দ্বাপর যুগের ২ × ৪৩২,০০০ বছর + কলিযুগের ৪৩২,০০০ বছর
৬. সত্য যুগ = ১,৭২৮,০০০ বছর
৭. ত্রেতা যুগ = ১,২৯৬,০০০ বছর
৮. দ্বাপরযুগ = ৮৬৪,০০০ বছর
৮. কলিযুগ = ৪৩২,০০০ বছর
২. মন্বন্তর কাল
আগেই বলেছি এটা বৈবস্বাত মন্বন্তর। প্রতি কল্পে ১৪ জন মনু জন্ম নেন। এই কল্পের মনুগণ যথাক্রমে –
১. স্বয়ম্ভূ মনু
২. স্বরোচিষ মনু
৩. উত্তমোজ মনু
৪. তাপস মনু
৫. রৈবত মনু
৬. চাক্ষুষা মনু
৭. বৈবস্বাত মনু (বর্তমান মনু)
৮. সাবর্ণি মনু
৯. দক্ষ সাবর্ণি মনু
১০. ব্রহ্ম সাবর্ণি মনু
১১. ধর্ম সাবর্ণি মনু
১২. রুদ্র সাবর্ণি মনু
১৩. দেবা সাবর্ণি মনু
১৪. ইন্দ্র সাবর্ণি মনু
দুই মনু জন্মের অন্তর্বর্তী কালকে মন্বন্তর বলে। এটি বৈবস্বাত মন্বন্তর। অর্থাৎ, বৈবস্বাত মনু আর সাবর্ণি মনুর মধ্যবর্তি সময়।
এই মন্বন্তরের ২৭টি মহাযুগ পার হয়ে ২৮তম মহাযুগের সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপর যুগ এবং কলির ৫১২০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
তাহলে দেখা যাক –
১. ১ কল্প = ১৪ মন্বন্তর = ১০০০ মহাযুগ
২. ১ মন্বন্তর = ১০০০ ÷ ১৪ মহাযুগ
মন্বন্তর কাল গণনা
১. ৬ মন্বন্তর
= ৬ × ১ মন্বন্তর
= ৬ ×১০০০ ÷ ১৪ মহাযুগ
= ৬ × ১০০০ ÷১৪ × ৪,৩২০,০০০ বছর
= ১,৮৫১,৪২৮,৫৭১ বছর
২. বর্তমান মনুর পার করা সময়
= ২৭ মহাযুগ + সত্য যুগ + ত্রেতা যুগ + দ্বাপরযুগ + কলিযুগের পার করা ৫১২০ বছর
= ৪,৩২০,০০০ বছর + ১,৭২৮,০০০ বছর + ১,২৯৬,০০০ বছর + ৮৬৪,০০০ বছর + ৫১২০ বছর
= ১২০,৫৩৩,১২০ বছর
৩. মনুগণের পার করা সময়
= শ্বেত বরাহ কল্পের পার করা সময়
= ১,৮৫১,৪২৮,৫৭১ বছর + ১২০,৫৩৩,১২০ বছর
= ১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
ব্রহ্ম কাল গণনা
১. ৬ ব্রহ্মার পার করা সময়
= ৬ × ১ ব্রহ্মার জীবন কাল
= ৬ × ১০০ ব্রহ্ম বর্ষ
= ৬ × ১০০ × ৩৬০ ব্রহ্ম অহোরাত্রি
= ৬ × ১০০ × ৩৬০ × ২ কল্প
= ৬ × ১০০ × ৩৬০ × ২ × ১০০০ মহাযুগ
= ৬ × ১০০ × ৩৬০ × ২ × ১০০০ × ৪,৩২০,০০০ বছর
= ১,৮৬৬,২৪০,০০০,০০০,০০০ বছর
২. বর্তমান ব্রহ্মার পার করা সময়
= ৫০ ব্রহ্ম বর্ষ + শ্বেত বরাহ কল্পের পার করা সময়
= ৫০ × ৩৬০ অহোরাত্রি + ১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
= ৫০ × ৩৬০ × ২ কল্প + ১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
= ৫০ × ৩৬০ × ২ × ১০০০ মহাযুগ + ১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
= ৫০ × ৩৬০ × ২ × ১০০০ × ৪,৩২০,০০০ বছর + ১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
= ১৫৫,৫২০,০০০,০০০,০০০ বছর + ১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
= ১৫৫,৫২১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
পূর্ণমান গণনা
আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের শুরু হতে এখন পর্যন্ত পার করা সময়
= ৬ ব্রহ্মার পার করা সময় + বর্তমান ব্রহ্মার পার করা সময়
= ১,৮৬৬,২৪০,০০০,০০০,০০০ বছর + ১৫৫,৫২১,৯৭১,৯৬১,৬৯১ বছর
= ২,০২১,৭৬১,৯৬৮,৯৬১,৬৯১ বছর
ব্রহ্ম কাল গণনা অর্থাৎ, আমরা জগৎ সৃষ্টি হতে ২,০২১,৭৬১,৯৬৮,৯৬১,৬৯১ বছরে আছি।
(সন ২০১৮ তে) মহাবিশ্বের উৎপত্তি: হিন্দু ধর্ম অনুসারে মহাবিশ্বের উৎপত্তি তত্ত্ব কি? ঈশ্বর কি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন? এই বিষয় বিস্তারিত আর জানতে পারবেন এখানে।
আর পড়ুন….