বাঙালি লুচির ইতিহাস

বাঙালি লুচির ইতিহাস

বাঙালি লুচির ইতিহাস:  লুচি. এই শব্দটার সাথে বাংলার প্রায় সকল ভোজনরসিকের হৃদয়ে একরাশ ভালোবাসার  স্পন্দন। লুচি, সে ফুলকো হোক বা বাসি, হেঁসেলে তার আবির্ভাবের খবরে পুলকিত চিত্ত, লালামিশ্রিত জিহ্বার স্বাদগ্রন্থি, মন খারাপের গুমোট সরে গিয়েনিমেষে প্রাণে বয়ে আনে খুশির বার্তা। 
 

‘লুচি’ নামটি শুনলে একটু গভীরে ভাবলে মনে হবে এটা কী আদৌ বাংলা শব্দ!! প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিতেও লুচি নামটি পাওয়া যায় না কোথাও।  তাহলে এই মুখরোচক অথচ অদ্ভুত নাম লুচি এল কোথা থেকে?? মতান্তরে,লুচি আদতে একটি হিন্দি শব্দ। ঘি দিয়ে লুচি ভাজলে সেটি হাতে নিলে পিছলে যায়,এই পিচ্ছিল হয়ে যাওয়াকে হিন্দিতে ‘লুচ’ বলা হয়,আর সেখান থেকেই লুচি। 

 

আবার আরেকটি মতে, লুচি সংস্কৃত শব্দ ‘লোচক’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘চোখের মনি’। আসলে লুচি যেহেতু চোখের মনির মত গোল তা বোঝাতেই এই রকম নামকরন।এক কালে লুচির ভাল নাম ছিল‘শষ্কুলী’। 
সুশ্রুতের ভেষজ শাস্ত্রের পুঁথির ওপর প্রথম ভাষ্য লেখেন চক্রপাণিদত্ত। তিনি এই বাংলারই মানুষ। হাজার বছর আগে তাঁর‘দ্রব্যগুণ’পুঁথিতে প্রথম লুচি বা শষ্কুলীর কথা পাই। 

 

 

এমনকি বেদ-পুরাণ রামায়ণ-মহাভারত আয়ুর্বেদীয় গ্রন্থে আমরা লুচির কোন উল্লেখ পাইনি।লুচির কথা তবে রান্নার বই থেকে নয়, সবার আগে পাওয়া গেল ডাক্তারির বইতে! পাল যুগের বিখ্যাত চিকিৎসক চক্রপাণি দত্ত একাদশ শতকে তার‘দ্রব্যগুণ’ গ্রন্থে আমরা লুচির সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাই। তিনি লিখেছেন,‘সুমিতায়া ঘৃতাক্তায়া লোপ্‌ত্রীং কৃত্বা চ বেল্লয়েৎ। আজ্যে তাং ভর্জয়েৎ সিদ্ধাং শষ্কুলী ফেনিকা গুণাঃ।।’ যার বাংলা অর্থ হল,‘গম চূর্ণকে ঘি দিয়ে মেখে, লেচি করে বেলে, গরম ঘিয়ে ভেজে তৈরী হয় শষ্কুলী, যার গুণ ফেনিকার মত। তা হলে তো লুচিকে খাঁটি আর আদি বাঙালি খাবারের মুকুট পরানো যেতেই পারে।বাঙালি লুচির ইতিহাস 

 

ভারতে প্রথম লুচির কথা জানা যায় পাল যুগে। সেইসময়কার বিখ্যাত চিকিৎসক চক্রপাণি দত্তের লেখা ‘দ্রব্যগুন’ গ্রন্হে তিনি প্রথম লুচির তিনপ্রকারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেগুলো হ’ল- খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। আসলে বেশী করে ময়ান দিয়ে ময়দা দ্বারা যা তৈরি করা হত তা ছিল খাস্তা লুচি। ময়ান ছাড়া ময়দা দিয়ে তৈরি লুচি ছিল সাপ্তা লুচি। আর ময়দার পরিবর্তে আটা দিয়ে যে লুচি তৈরি হত তা ছিল পুরি।পাল যুগের সেই খাস্তা লুচিই বাঙালির কাছে বর্তমানের প্রচলিত লুচি হিসেবে খ্যাত। বহু বাঙালি বাড়িতে ময়দার পরিবর্তে শুধু  আটা দিয়ে লুচি করা হয়। আদতে সেটা লুচি নয়,সেটাকে বলা হবে পালযুগের মত অনুযায়ী ‘পুরি’,যা উত্তরভারতের একটি প্রচলিত জলখাবার।

 

মানিকলাল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ধর্মমঙ্গলে লুচিকে জনপ্রিয় খাদ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাঙালির লুচিপ্রীতির অনেক নমুনা ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ছড়া-গল্প-উপন্যাসে। বিভূতিভূষণের‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ -এর চালের বাতায় লুচি ভাজার খুন্তি গুঁজে রাখতেন হাজারী ঠাকুর। না জানি তাঁর হাতযশে সেই লুচির কী অসাধারণ স্বাদ খুলত! বাঙালি লুচির ইতিহাস

 

এছাড়া শরত্‍‍চন্দ্রের উপন্যাসের একাধিক নায়িকা লুচি ভাজায় দস্তুরমতো বিশেষজ্ঞ ছিলেন বলে মনে হয়। পাঠকমাত্রেই নিশ্চয়ই এটা মনে রেখেছেন যে,‘চরিত্রহীন’-এ গভীর রাতে উপেন্দ্রনাথকে বলা কিরণময়ীর সংলাপ,‘আমার সঙ্গে রান্নাঘরে এসো, দুখানা লুচি ভেজে দিতে আমার দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।’ 
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে নাকি কথায় কথায় লুচির ছড়া ছুটত, অবনঠাকুরের লেখায় তেমনই হদিশ মেলে।

 

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের লেখা‘খাই, কিন্তু জানি কি’ বইটি এই প্রসঙ্গে মূল্যবান এক গ্রন্থ। আমরা রোজ যা খাই, ভাত, ডাল, শুক্তো, চচ্চড়ি থেকে শুরু করে দই মিষ্টি এসব খাবারের সৃষ্টি হল কীভাবে? বাঙালি লুচির ইতিহাস

 

ঊনবিংশ শতাব্দর শেষ আর বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কলকাতায় ফুচকার আগমন, কজনই-বা তা জানেন? বাঙালির অতি প্রিয় সিঙ্গাড়ার আগমন কচুরির মতোই কাশীধাম থেকে, তাই-বা কে খেয়াল রাখেন। রসরাজ অমৃতলাল বসুর লেখা‘বৌমা’ নাটকের গানে লেখক সিঙ্গাড়ার উল্লেখ দেখান।‘তপত কচুরি ঘিয়েতে ভাজে/ পুরত সিঙাড়া আলুয়া সাজে/ করব গরম তেয়াগি লাজে/ শাশুড়ি লেয়াওলেয়াও লো’।

 

গোটা বইটিতেই খাদ্যভাবনা, খাদ্য ইতিহাস নিয়ে প্রচুর গবেষণালব্ধ তথ্য আছে। তবে তথ্যের ভারে তা নীরস হয়ে ওঠেনি মোটেই। যে-কোনও বাঙালি বাড়িতে রোববারের জলখাবার মানেই সাদা ধবধবে নরম, গরম ফুলকো লুচি আর কালোজিরে ছেটানো আলুর সাদা তরকারি। লেখক লিখছেন,‘লুচি হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল ধবধবে সাদা আর নিখুঁত। লুচিতে দাগ থাকা আর চরিত্রে দাগ সেকালে একইরকম দোষের মানা হত।’ তথ্যের সঙ্গে এমন নানারকম সরস মন্তব্য মিলেমিশে থাকায় সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে এই বই।

 

লেখকের পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনাও এই বইয়ের বিশেষ গুণ। লুচি বেলার পদ্ধতি আলোচনার পাশাপাশি তার ব্যাস যে তিন-চার ইঞ্চির বেশি হবে না, তাও জানিয়ে দিতে ভোলেননি তিনি। তাঁর গবেষণা থেকে জানতে পারি মুর্শিদাবাদের কোনও কোনও অঞ্চলের লুচি হত পদ্মপাতার মতো বড়। 

 

মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বাংলাদেশের কান্তনগরের লুচিও বেশ বড়মাপের হত। কান্তনগর দিনাজপুর থেকে বারো মাইল দূরে। দিনাজপুরের রাজবাড়িতে কান্তজির ভোগ হিসেবে প্রতিদিন‘বগি’ থালার মতো বড় লুচি তৈরি হত। সেই লুচির বিশেষত্ব ছিল, লুচি না ভাঙলে ফোলা অবস্থায় থেকে যেত। মাটির সরা বা পাতলা বাঁশের পাতার খাঁচায় করে ওই লুচি এপার বাংলাতেও এসেছে। আমাদের প্রতিদিনের চেনা খাবার সম্পর্কে এমন হাজারো তথ্যে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন লেখক।

 

একসময় সবচেয়ে বড় আকারের লুচি পাওয়া যেত দিনাজপুরের কান্তনগরের কান্তজিউ মন্দিরের ঠাকুরবাড়িতে,যা একেকটা থালার মত আকারে থাকতো। মন্দিরের ভক্তরা দুহাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দই দিয়ে এই লুচি প্রসাদ হিসেবে খেতেন। বাঙালি লুচির ইতিহাস

 

আবার বর্তমানে মালদহ জেলার ইংরেজবাজারের সাদল্লাপুর শ্মশানের কাছে হাতির পায়ের ন্যায় বৃহৎ লুচি পাওয়া যায়,যার ব্যাস প্রায় ১০ ইঞ্চির কাছাকাছি। 

 

একই রকম ভাবে মেদিনীপুরের রাধামোহনপুরের পলাশী গ্রামের নন্দী পরিবারের ঠাকুরবাড়িতে ভোগ হিসেবে যে লুচি দেওয়া হয় তার ব্যাস ১-১.৫ ইঞ্চির মত। মনে করা হয় এটি বাংলার সবচেয়ে ছোট লুচি।