পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ: বই-ত নয় যেন একটি স্ফুলিঙ্গ (১৯৪৬) (১৯৪৬ সাল। ভারতে তখনও ইংরেজ শাসন চলছে। অবিভক্ত বাঙলায় তখন সুরাবর্দীর নেতৃত্বে মুসলীম লীগ-এর সরকার। স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে, সারা ভারত সে আন্দোলনে উত্তাল। দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে মুসলীম লীগ কোলকাতার বুকে শুরু করলাে Direction Action। কলকাতায় হল নির্বিচারে হিন্দু হত্যা। Statesman লিখল ‘The Great Calcutta Killing’ নির্বাচারে হিন্দু হত্যা। বিভৎস সে হত্যাকাণ্ড।
এখানেই শেষ হল না। ১০ই অক্টোবর ১৯৪৬ অবিভক্ত বাঙলার নােয়াখালি জেলায় শুরু হল হিন্দু হত্যার দাঙ্গা। হাজারে হাজারে হিন্দুর ঘরবাড়ী পুড়লাে, হিন্দুর ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন চললাে। হাজার হাজার হিন্দু নির্মমভাবে নিহত হল।
কিছু হিন্দুকে জোর করে মুসলমান করা হল, কিছু মায়েদের, মেয়েদের মুসলমানের ভােগদখলে নেওয়া হল। দিনের পর দিন ঘটে চলা সে ঘটনা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি নিদারুন। মর্মান্তিক। এরই মধ্যে আক্রান্ত তথাকথিত ধর্মান্তরিত কিছু নারী-পুরুষ কোনরকমে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। তারা স্বধর্মে ফিরতে চান।
করাচী শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনে জেহাদী আক্রমন দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে পাকিস্থান তৈরীর সাথে সাথে জেহাদী ইসলামীরা করাচীর বিরাট রামকৃষ্ণ মিশনকে জ্বালিয়ে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে ৬০ হাজার বই-এর গ্রন্থাগার। করাচীর ঐ মঠের প্রধান ছিলেন স্বামী রঙ্গনাথানন্দ। যিনি পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি হয়েছিলেন। করাচীর ঐ মিশনের পাঠাগারে স্বামী রঙ্গনাথানন্দর বক্তৃতা শুনতে আসত জিন্না, লালকৃষ্ণ আদবানী।
স্বামী রঙ্গনাথানন্দ করাচী থেকে এক বস্ত্রে তাও সাদাবস্ত্রে করাচী থেকে বিমানে চলে আসেন ঢাকা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে আসেন ঢাকার রামকৃষ্ণ আশ্রমে জীবন হাতে নিয়ে।
এই সময় ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়া আসা ছিল এখন একটি স্কুলছাত্রের নাম শ্রীরবীন্দ্রনাথ দত্ত। ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের মঠাধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞানানন্দজী মহারাজের প্রিয় পাত্র রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছেন। এই সময় রামকৃষ্ণ মিশন প্রকাশ করেছেন ‘পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজ। পুনর্মুদ্রণের জন্য এই পুস্তিকা আমরা নােয়াখালি ও ঢাকা থেকে সেই ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে প্রাণে বেঁচে আসা এবং বর্তমান সল্টলেক লাবনী নিবাসি শ্রী রবীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে পেয়েছি।
‘পূর্ববঙ্গ ও হিন্দু সমাজের সাথে রবীন বাবুর সেই সময়ের স্মৃতিকথা আজ এক ইতিহাস। শুধু কোলকাতা নােয়াখালি নয়। জেহাদী আক্রমন ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনেও হয়েছে। সেই ইতিহাসও এই স্মৃতি কথায় পাব। স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে রাখতে হবে—যে কেহ হিন্দু ধর্ম হইতে বাহিরে যায়, আমরা যে কেবল তাহাকে হারাই তাহা নয়। একটি শত্ৰু অধিক হয়।)
বইত নয় যেন একটা স্ফুলিঙ্গ ১৯০ বৎসর ভারতে রাজত্ব করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে অবস্থারচাপে ইংরেজরা যখন এদেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন ঝােপ বুঝে কোপ মারার জন্য ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা কাফের (ঘৃণিত) হিন্দুদের সঙ্গে এক সাথে থাকলে ইসলাম বিপন্ন হবে ধুয়া তুলে তাদের জন্য একটা আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের মহড়া হিসাবে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন হিসাবে ঘােষণা করে কলকাতা এবং মুসলিম লীগের।
আর্তুড়ঘর ঢাকা শহরে যে প্রলয় কান্ড ঘটিয়েছে তার বিস্তৃত বিবরণ আমি আমার লিখিত বইগুলােতে উল্লেখ করেছি, ঢাকা শহরে ১৬ই আগষ্ট এর নিহত হিন্দুদের মৃতদেহ গুলাে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ট্রাক বােঝাই করে আমাদের পাড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হতাে। তাতে ছিল উলঙ্গ মহিলা এবং মস্তকহীন শিশুদের মৃতদেহও। বাধ্য হয়ে আমরা ট্রাক থেকে হাত পা ধরে মৃতদেহগুলি নাবিয়ে গণসত্ত্বার করাতাম।
ট্রাকের চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে গিয়েছিল। মানুষের মাংসে শকুন কুকুরেরও অরুচি ধরে ছিল। এরপর যখন হিন্দু এবং শিখরা রুখে দাঁড়াল তখন মুসলিম লীগ সরকার। প্রমাদ গুনলাে। এরপর মুসলিম লীগ বেছে বেছে বাংলার সবচেয়ে হিন্দু সংখ্যালঘু জেলা নােয়াখালী তাদের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গিনিপিগ হিসাবে ১০ অক্টোবর ১৯৪৬ সেখানে হিন্দু নিধন আরম্ভ হলাে হত্যা লুটপাঠ অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণ, বলপূর্বক বিবাহ, অপহরণ মহিলাদের মাটিতে চিৎকরে শুইয়ে, বুড়াে আঙ্গুল দিয়ে সিথির সিঁদুর মুছে দেওয়া, গরু জবাই করা রক্ত দিয়ে মূর্তিগুলি স্নান করানাে।
এবং তারপর সেগুলিকে টুকরাে টুকরাে করে ভেঙ্গে ফেলার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আদায়ের জন্য হিন্দুদের মনে ভীতি সঞ্চার করার প্রয়াস করা হলাে। এই বর্বরােচিত ঘটনা প্রথম দশদিন লীগ সরকার গােপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল কারণ।
সমস্ত টেলিগ্রাফের তার কেটে, রাস্তা কেটে নােয়াখালীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। এরপর অবস্থা একটু শান্ত হলে নােয়াখালীতে স্বেচ্ছাসেবকরা যেতে আরম্ভ করলাে। গান্ধীজি এই হত্যালীলা আরম্ভ হওয়ার ২৭ দিন পর গিয়ে গ্রাম পরিক্রমা আরম্ভ করলাে, ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে কিছু স্বেচ্ছাসেবক ননায়াখালী রওনা হলাে। আমিও যাবাে বলে মনস্থির করলাম ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী জানাত্মানন্দের একজন অত্যন্ত প্রিয় পাত্র এবং মঠের একজন কর্মী হিসাবে যাত্রার আগের দিন বৈকালে গিয়ে মহারাজের সাথে দেখা করলাম।
তিনি বল্লেন “তুই যখন যাচ্ছিস দেখত ঐ প্যেকেটে কিছু বইপত্র এসেছে মনে হয় নােয়াখালী সম্বন্ধে কিছু খবর আছে।” তখন মঠের রান্নাঘর থেকে সজি কাটার বীঠ এনে প্যেকেটের দড়ি কেটে এক কোনা থেকে ৭/৮ টা বই নিয়ে বাড়ী ফিরলাম। রাত্রে বইগুলি চোখ বােলানাের সময় হয়নি।
পরের দিন ঢাকা থেকে রওনা হয়ে তার পরদিন সকালে চৌমুহনী ষ্টেশন থেকে প্রায় ৪ মাইল পশ্চিমে আমার গ্রামের বাড়ী কালিকাপুর পৌছালাম, ইতিমধ্যে অনেক স্বনামধন্য নেতা নেতৃ চৌমুহনীতে ওখানকার ধনী ব্যবসায়ীদের আতিথ্য গ্রহণ করে তার পর গ্রামগুলির দিকে রওনা হলেন। আর যারা অত্যন্ত সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক প্রাণের টানে সেখানে গিয়েছেন তারা সব আমাদের বাড়ীতে উঠেছে।
আমিও তাদের সাথে উদ্ধার কাজে রওনা হলাম, তাদের অনেকের নাম আমার এখন আর মনে নেই তবে শ্রী অমর সরকার, রমেন চক্রবর্তী, যােগেশ চৌধুরীর নাম আমার বিশেষ করে মনে আছে। তারা কংগ্রেস সােসালিষ্ট পার্টি করতাে। গ্রামগুলিতে গিয়ে দেখি হিন্দুরা সব মুসলমান হয়ে বসে আছে পরনে লুঙ্গী, মাথায় সাদা টুপির উপর ভারতের মানচিত্র তার মধ্যে যে অংশগুলি তারা পাকিস্তান বলে দাবি করছে তা সবুজ রংএ ছাপা, লেখা।
পাকিস্তান জিন্দাবাদ। মহিলাদের হাতে শাখা নেই কপালে সিঁদুর নেই, চোখগুলি জবাফুলের মত লাল। মন্দিরগুলাের কোন চিহ্ন নেই। আমরা তাদেরকে বল্লাম আপনারা চলুন উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যাবে। তারা প্রশ্ন করলাে বাবু আমরা। কলমা পড়ে মুসলমান হয়েছি নামাজ পড়েছি। আমাদের মুখে গােমাংস দিয়েছে বাড়ীর মেয়েদেরকে অপহরণ করা হয়েছে।
হিন্দুরা কি আমাদের আবার সমাজে নেবে? আমাদের হাতে কি জল খাবে? আমরা বল্লাম আমাদের ধর্মগুরুরা এই নির্দেশ দিয়েছে আপনারা বিনা দ্বিধায় স্বধর্মে ফিরতে পারবেন। তারা আমাদের মুখের কথা বিশ্বাস করলাে না। তখন ছাপার অক্ষরের বই পড়তে তারা বিশ্বাস করলাে এবং দলে দলে বাড়ী ছেড়ে আমাদের সাথে বেরিয়ে এলাে।
এতে মুসলমানরা আপত্তি করলাে না। কারণ হিন্দুরা চলে গেলে স্থাবর অস্থাবর জমি জমা পুকুর তাদের দখলে আসবে। ইতিমধ্যে এই বই এর সংবাদ দাবানলের মত স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লাে, প্রথম দিনের বইটা তারা টানাটানি করে ছিড়ে যে যা পেরেছে এক এক পৃষ্ঠা এক একজন নিয়ে গেছে। এই বই-এর পৃষ্ঠা দেখিয়ে ধর্মান্তরিত হিন্দুদেরকে বের করে আনতে আরম্ভ করলাে।
এই বই-এর। সংবাদ কোনক্রমে কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালনীর স্ত্রী সুচেতা কৃপালনীর নিকট গেল। রাত্রে বাড়ি ফিরে এলাম, পরদিন সকালে ৩/৪ কপি সঙ্গে নিয়ে গেলাম এবং সুচেতা কৃপালনীর সাথে আমার দেখা হলাে। বইটায় চোখ বুলিয়ে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বল্লেন তুই করছিসটা কি রবি ? এরপর তার সাথে আমার অনেক বার দেখা হয় আমি তাকে পিসিমা বলে ডাকতাম।
আমার এক পিসিমা উষারাণী গুহরায় সুচেতা কৃপালনীর নারী উদ্ধারের স্বেচ্ছাসেবিকার কাজ করতেন। ঐসব কাজে আমার পূর্ব পরিচিত অনেক নেতা নেত্রীর সঙ্গে দেখা হয় তার মধ্যে শ্রীমতী লীলা রায় এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
এর পর থেকে পড়ুন..