দেশ ত্যাগ, দেশ প্রেম, পহেলা বৈশাখ-দুরর্ম

দেশ ত্যাগ, দেশ প্রেম, পহেলা বৈশাখ। দেশভাগের আগে বাংলাদেশে ৩১ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর অবস্থান ছিল। ধরা যাক এখনো ৩১ শতাংশ হিন্দু বাংলাদেশে বসবাস করছে। তাহলে মুসলমানদের পরিমাণ হবে ৬৯ শতাংশ। এবার ভাবতে পারি ‘৬৯ ভাগ মুসলমানের দেশে’ কি মঙ্গল শোভাযাত্রা চলতে পারত?  আদালতের সামনে গ্রীক ভাস্কর্য, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা কি সহজ হবে? বুঝতে চাইছি আসলে ‘৯০ ভাগ মুসলমানই’ মূল সমস্যা কিনা…।

এটা ঠিক দেশভাগের প্রধান আঘাতটা পড়েছিল অবস্থাসম্পন্ন হিন্দুদের উপর। সমাজে প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত শ্রেণী যাদের হাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল মূলত তারাই প্রাণভয়ে, ভবিষ্যত চিন্তা করে দেশত্যাগ করেছিলো। এ কারণেই দেখা যায় দেশভাগের পর ১৯৫১ সালের আদম শুমারীতে হিন্দু জনগোষ্ঠির পরিমাণ ২২ শতাংশ। অর্থ্যাৎ ৯ শতাংশ হিন্দু দেশভাগ করে চলে যান।

মূলত নিন্মবিত্ত, সমাজে পিছিয়ে থাকা হিন্দুদের বেশির ভাগ তখনো থেকে গিয়েছিল। সামজে নিজেদের হয়ে কথা বলার মত, জবাবদেহী চাওয়ার মত, সংখ্যাগরিষ্ঠের গোণার মত সামাজিক অবস্থান পাকিস্তান আমলে হিন্দুদের মধ্যে খুবই কম ছিল।

তবু পরবর্তী দশ বছরে অর্থ্যাৎ ১৯৬১ সালে ১৮.৫ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যাই বলে দেয় নিয়মিতভাবেই হিন্দুরা দেশ ছাড়ছিল…। সেই ধারা অব্যাহত রেখে আজকে বাংলাদেশের পরিচয়ই হয়ে পড়েছে ‘৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ’! খুবই ভয়ংকর একটি পরিচয় এটি। মুসলমানরা যখন ৯০ শতাংশ হয়ে পড়ে তখন দেশে কোন বাঘ-ভাল্লুকের মুখোশ পরে নিরহ পদযাত্রাও নিষিদ্ধ হয়ে যায়!

শিক্ষাক্রম থেকে শুরু করে দেশের সংবিধানে ধর্মের টিকা দেগে দেয়া হয়। হরেদরে মাথার দাম হাঁকানো চলে। দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া চলে। জোরজবস্তি সম্পত্তি দখল করা চলে…।

 

বিষয়টা এমন নয় যে মুসলমানরা শতকরা একশ ভাগ বা ৯০-৯৫ ভাগ হলেই নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় মনোভাবের বর্হিপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করে। মালয়েশিয়ার ৪০ শৎতাংশ অমুসলিম জনগোষ্ঠি হবার পরও সেখানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছে!
তাদের সংবিধানের ১৬০ ধারা মতে মালয়দের অবশ্যই মুসলিম হতে হবে তবেই তাদের স্বীকৃতি মিলবে। এছাড়া কেউ ইসলাম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ না করার আইন পাশ করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার অনেক প্রদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শরীয়া শাসন চালু করেছে। একমাত্র বালি দ্বীপের হিন্দু জনগোষ্ঠির শক্ত অবস্থানে কারণে সেখানে মন্দিরসহ কিছু তীর্থকেন্দ্র রয়েছে।
যেখানে বিগত বছরগুলোতে কয়েক দফায় ইসলামী জিহাদী হামলা চলেছে। মালদ্বিপের মত ছোট্ট একটা দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম! সেখানে কেউ ভিন্ন ধর্ম পালন করতে পারবে না এবং ইসলাম ভিন্ন অন্য ধর্ম গ্রহণ করতেও পারবে না। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর ইহুদী, খ্রিষ্টান ও জরথ্রুস্তপন্থীরা সব নিশ্চিহৃ হয়ে গেছে।
তারা কোথায় গেছে এরকম প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া মুসলমানরা কখনো সত্য কথাটা বলে না। মিশরের ১০ ভাগ কপটিক খ্রিস্টান হবার পরও অঘোষিতভাবে তাদের নাগরিক হিসেবে কখনোই সমমর্যাদা ছিল না। আব্রাহিমিক ধর্ম ছাড়া হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের কোন স্বীকৃতি মিশরে নেই। এছাড়া সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোতে কেবলমাত্র মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষদের নাগরিত্ব দেয়া হয় না।
মুসলিম বিশ্বের গর্ব এই দেশগুলোতে কেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদীসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র ধর্ম ও জাতি সত্ত্বা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না- তার সঠিক উত্তর ‘বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ’ কোনদিনই দিতে পারেনি। পক্ষান্তরে ৭০ ভাগ বৌদ্ধ শ্রীলঙ্কা, ৮০ ভাগ হিন্দু নেপাল, ৯০ ভাগ বৌদ্ধ ভূটান এবং ৮০ ভাগ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠির নিশ্চিহৃ হবার কোন ইতিহাস নেই।
শুধু মুসলিম কেন, এইসব দেশে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ধর্মীয় বা সামাজিক বৈষম্য করার মত রাষ্ট্রীয় বিধান জারি করেনি। এদের কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। বাংলাদেশের আবুল বারাকাতের গবেষণাসহ নানা দেশী-বিদেশী সংস্থা বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের দেশত্যাগের কারণ হিসেবে নির্যাতন, সম্পত্তি দখল, নিরাপত্তহীনতাসহ রাষ্ট্রীয় নানা বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশের এরকম সাম্প্রদায়িক চিত্রকে জাস্টিফাই করার জন্য সব সময় ভারতের মুসলিম নির্যাতনের প্রসঙ্গ তোলা হয়।
খুবই কৌতূহলী বিষয় হচ্ছে- একই মাত্রায় যদি ভারতে মুসলিম নির্যাতন ঘটে থাকে তাহলে ভারতীয় মুসলিমরা পাশ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে না কেন? এর কোন জবাব সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে নেই বিধায় ‘ভারতের মুসলমানদের দেশপ্রেম বেশি বলে তারা দেশ ত্যাগ করে না’ প্রলাপ বকাই সম্বল…।
৯০ ভাগ খ্রিস্টান দেশে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকতে পারলে সেটা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে উল্টো হয়ে যায়। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আফগানিস্থান। একদা বৌদ্ধদের এই দেশটি আজ শরীয়ার কষাঘাতে খোদ মুসলিমরাই টিকতে না পেরে পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে পাড়ি জামিয়েছে। নিশ্চিহৃ হয়ে গেছে বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমকে তবু বুঝা যায় কিন্তু ‘সংখ্যালঘু মুসলিম’?
আদৌ ‘সংখ্যালঘু মুসলিম’ বলতে কিছু আছে কি? সংখ্যালঘু বলতে আমরা যে সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা নিপীড়িত আর বৈষম্যের শিকার অসহায় জনগোষ্ঠিকে বুঝি তারা কি সেই কাতারে পড়ে? ব্রিটিশরা ভারতে সংখ্যায় কম হয়েও ভারত শাসন করেছিল। তাদের দাপটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় মাথানত করে থাকত।
ভারতে মুসলিম শাসনের ক্ষেত্রেও একই কথা। ইউরোপ-আমেরিকাতে পাতাল রেলে, শপিংমার্কেটে, নাইটক্লাবে যারা জিহাদী হামলা চালায় তাদের কি ‘সংখ্যালঘু’ ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। যারা কার্টুনিস্ট, চিত্র পরিচালক, লেখক, অভিনেতাকে ইসলাম অবমানানোর অভিযোগে প্রকাশ্যে হত্যা করে দায় স্বীকার করে তারা ইউরোপে সংখ্যায় কম বলেই কি তাদেরকে আমাদের চিরচেনা ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের সঙ্গে মেলানো যায়?
পশ্চিমবাংলা যাদের হুমকিতে তসলিমা নাসরিনকে বের করে দেয়া হয়, যাদের হুমকির ভয়ে সালমান রুশদীকে ভারতে আসতে দিতে পারা যায় না- তারা কেমন ‘সংখ্যালঘু’? জামার্নিতে ‘বেপর্দা নারীদের’ যেসব ধর্মীয় শরণার্থীরা ধর্ষণ করেছিল তারা কি সংখ্যালঘু ইয়াজিদিদের সঙ্গে তুলনীয়?
সালমান রুশদীর উপন্যাসে নবী মুহাম্মদকে হেয় করার অভিযোগে ইরানী সরকার তার মাথায় দাম হাঁকে কিন্তু আফগানিস্থানে গৌতম বৌদ্ধের মূর্তি কামান দাগিয়ে ভেঙ্গে ফেললেও তথাকথিত বৌদ্ধ দেশগুলো কয়জন তালেবানের মাথার দাম হাঁকিয়ে ছিল? … এই তফাত আর একচোখা নীতিগুলোর কথা বললেই আমি মুসলিম বিদ্বেষী! ইসলাম বিদ্বেষী!…
অথচ মুসলিমদের সময় এসেছে এভাবেই নিজেদের যাচাই করে নেয়ার। সেক্যুলারিজম যেমন তাদের খ্রিস্টান-হিন্দু-বৌদ্ধদের দেশে তাদের ধর্মীয় সামাজিক রাষ্ট্রীয় অধিকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বৈষম্যহীনভাবে নিশ্চিত করতে পেরেছে তাদেরও উচিত নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থান থেকে সেই একই পন্থা গ্রহণ করা।
মঙ্গল শোভাযাত্রা হতে পারে সেই লক্ষ্যে একটা পদক্ষেপ। ইসলামী ফান্ডামেন্টালিস্ট থেকে শুরু করে, ‘ইসলামী বামপন্থি’ ‘ইসলামী সেক্যুলার’ তাদের সকলের কুপ্রচারের বিরুদ্ধে সারাদেশে বৈশাখের প্রথম দিবসে মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্বতস্ফূত অংশগ্রহণই হতে পারে সেই লক্ষে যাবার আশা জাগনিয়া ছোট্ট একটি কদম…।
লেখক-পাঠক।