এ ইতিহাস আমাদের পূর্বপুরুষের অপমানের ইতিহাস।-দুরর্ম

পূর্বপুরুষের অপমানের ইতিহাস

এ ইতিহাস আমাদের পূর্বপুরুষের অপমানের ইতিহাস। আপনারা নিশ্চই রাজশাহীর একটাকিয়া রাজাদের কথা শুনেছেন, রাজশাহীর চলনবিল এলাকায় সপ্তদূর্গা বা সাতপাড়ায় যাদের রাজধানী ছিল। এরা রাজা হলেও প্রতি বছর একবার অন্তত গৌড় বা দিল্লীর বাদশাহর নিকট গিয়ে তাদের বন্দনা করতে বাধ্য ছিলেন। সেই নিয়ম  অনুসারে রাজা মদন নারায়ন নিজের দুই পুত্র কন্দর্প নারায়ন ও কামদের নারায়নকে সঙ্গে নিয়ে গৌড়ের বাদশাহ (নবীজীর বংশদর বলে পরিচিত) সৈয়দ হোসেন শাহ-র সাথে সাক্ষাত করতে আসলেন।

সৈয়দ হোসেন শাহ-র চার স্ত্রীর গর্ভে বহু কন্যা সন্তান হয়েছিল। তার মধ্যে দুটির বয়স ২০ বছরের  অধিক হয়েছিল, অথচ যোগ্য পাত্র না পাওয়ায় তাদের বিয়ে দিতে না পারায় খুব চিন্তিত ছিলেন। হোসেন শহ সৈয়দ বংশের লোক, নিন্মশ্রেনী থেকে ধর্মান্তরিত এ সকল দেশীয় মুসলমানগনকে তিনি সমকক্ষ বলে মনে করতেন না। তাই হোসেন শাহ দেখলেন মদনের পুত্রদ্বয় অতি সুন্দর, বিদ্বান , বুদ্ধিমান এবং যুবা পুরুষ। তারা কুলীন ব্রাম্মন এবং রাজপুত্র। সুতরাং সর্বাংশেই তারা কন্যার যোগ্য পাত্র।

তিনি অমনি মদকে স্বপুত্রক আটক করে তার মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব করলেন। রাজা মদন অতি বিনীতভাবে বললেন, ধর্মাবতার, আপনি আমাদের রাজা এবং রক্ষক, আমি আপনার একান্ত অনুগত এবং হিতার্থী ভৃত্য। আমার প্রতি অত্যাচার করা হুজুরের পদমর্যাদার অযোগ্য। বাদশাহ চতুরতা পূর্বক বললেন  – দেখুন আমি একটাকিয়ার রাজবংশকে অতিশয় ভালবাসি এবং মান্য করি ।

আপনাদের কন্যা যেমন অপর কোন হিন্দু বিয়ে করতে পারেনা , তেমনি আমাদের কন্য ও সৈয়দ বংশের বাইরে কোন মুসলিম বিয়ে করতে পারে না। আপনাদের অতীব সম্ভ্রান্ত জেনেই আপনার পুত্রদ্বয়ের সঙ্গে আমি আমার দুই কন্যার বিয়ে দিতে ইচ্ছা করি, কোনরূপ অত্যাচার করার অভিপ্রায় আমার নেই। আমি আপনাদের মুসলমান হতে বলিনা, বরং পত্নীই পতির ধর্ম অনুসরন করবে।

ইহাই জগতের সাধারন রীতি। আপনি যদি আমার কন্যাদের স্বজাতিতে মিলিয়ে নিতে চান, আমি সম্মত আছি। নতুবা আপনার পুত্ররা আমার ধর্ম গ্রহন করুক। আমি তাদের আমার স্বজাতিতে মিলিয়ে নেব। এই উভয় প্রস্তাবের মধ্যে যেটি আপনার বাঞ্চিত হয় আমি সেটাই মেনে নিব। কিন্তু যদি আপনি উভয় অস্বীকার করেন, তবে আমি বলপূর্বক আপনাকে বাধ্য করবো।

রাজা মদন বাদশাহের উগ্র স্বভাবের কথা জানতেন। তিনি দেখলেন বাদশাহর প্রস্তাব অস্বীকার করলে বহু লোকের প্রাণনাশ ও জাতি নাশ হবে। আর মুসলমান মেয়েকে নিজ জাতিতে মেলাবার কোন উপায়ও নাই। অগত্যা তিনি পুত্রের মায়া ত্যাগ করলেন। তারা মুসলমান হয়ে শাহজাদীদ্বয়কে বিয়ে করলেন।

হোসেন শাহ পরে মদনের অন্য পুত্র ও ভাতুষ্পুত্র সহ আরো এগারো জনকে ধরে এনে মুসলমান বানালেন এবং তাদের সঙ্গে নিজের অবশিষ্ট সমস্ত কন্যাদের বিয়ে দিলেন। রাজা মদন চতুর্থ পুত্র রতিকান্তের দৃষ্টিশক্তি কম ছিল, সে রাতে একেবারেই দেখতে পেতোনা। বাদশাহ কেবল তাকে ছেড়ে দিলেন। বাদশাহ রসিকতা করে মদনকে বললেন- বুঝেছেন, যে অন্ধ সে হিন্দুই থাকুক, আর যার চক্ষু আছে তার মুসলমান হওয়া উচিত।

এইভাবে শুধু একটাকিয়ার রাজ পরিবার থেকে ২৯ জন রাজ কুমারকে মুসলমান করা হয়েছিল। সম্রাট আকবর একটাকিয়ার রাজকুমার চন্দ্র নারায়ন এবং সংগীত শাস্রবিদ বিখ্যাত কাশ্মিরী পন্ডিত তানসেনের সাথে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। আরঙ্গজেবের প্রথম জামাতা  কাশ্মিরী পন্ডিত কৃষ্ণ নারায়ন।

আলমগীর ততকালীন বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাকে আদেশ দিয়েছিলেন যে, একটিয়ার ঠাকুর বংশে সুপাত্র থাকলে তাদের আটক করে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করে প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় দিল্লীতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এই পাত্র যে পর্যন্ত ভক্ত মুসলমান না হয় সে পর্যন্ত যেন তাকে দিল্লিতে পাঠানো  না হয়। কেননা তার কন্যার বর ঘৃণিত কাফের হলে তার সামনে হজির হওয়া  তিনি ইচ্ছা করেন না।

আমার দাদীর কাছে থেকে এই ইতিহাস ছোট বেলায়ই শুনেছি । দাদী আরো বলেছিলেন, আমরা রাজকুমার কন্দর্প নারায়নের বংশধর। কামদেব নারায়ন অদৃষ্টকে মেনে নিলেও কন্দর্প নারায়ন মনে প্রাণে মুসলমান হতে পারলেন না। কিন্তু অন্য কোন উপায়ও ছিল না। তাই বংশ পরম্পরায় এই ইতিহাস পরবর্তী বংশধরদের জানিয়ে রাখতে হুকুম করে দিয়েছিলেন তিনি।

আমি কন্দর্প নারায়নের -২৩ তম বংশধর। আমার পূর্বপুরুষের সেই অপমান অত্যাচারের জ্বালা আমার রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু তা বলে আমি কালাচাদ ওরফে কালা পাহাড়ের মত দুলারী বিবিকে এবং যদুকে ওরফে জালালুদ্দিনের মত আশ্মান তারাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়ে স্বজাতির প্রতি আক্রোশ বশত ইসলামী বর্বরতা চেপে যাওয়ার মত আহাম্মক নই ।

কি আশ্চর্য, আমার পূর্বপুরুষ তার কালা পাহাড় শুধু বিয়ে করতে বাধ্য হয়ে সমাজচ্যুত হয়েছিলেন, অথচ এদেশের ৯০ সতাংশ মুসলমান কালা পাহাড়, জালালউদ্দিন সহ অন্যদের অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল সে কথা এরা মনেই রাখেনি।

মধ্যযুগে ইসলামী সুনামীর বর্বরতার মরূভূমির বালি এসে এদেশের  উর্বর মাটি ঢেকে ফেলেছে। সে মরু বালি সরিয়ে উর্বর মাটি পূনরুদ্ধারের কারো কোন ইচ্ছা নাই। অন্ধকার রাতের ঝড়-ঝঞ্জায় নাবিক পথ হারালে ভোর হলে তিনি সঠিক পথের সন্ধান করে নেন। অথচ আশ্চর্য , এরা কেউ সঠিক পথের সন্ধান করছেন না।

সত্যিই বাংলার মানুষের বড় ভূলো মন। এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাতে আমি মধ্যযুগীয় মুসলিম বর্বরতার কিছু ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তুলে ধরতে চেয়েছি আমাদের পূর্ব পুরুষ কোন পরিস্থিতিতে মুসলমান হতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বিনীত_

নূসরাত জাহান আয়েশা সিদ্দিকা (জয়শ্রী আচার্য)

আরো পড়ুন….

Scroll to Top