রিফিউজির

রিফিউজির : প্রত্যেকের কপালে জ্বলজ্বল করছে অদৃশ্য এক টীকা – ‘রিফিউজির বাচ্চা’ !

রিফিউজির : প্রত্যেকের কপালে জ্বলজ্বল করছে অদৃশ্য এক টীকা – ‘রিফিউজির বাচ্চা’ ! বর্তমান অবস্থান দিয়ে যতোই মুছে ফেলার চেষ্টা করি, আমাদের ( বাঙালিদের) প্রায় প্রত্যেকের কপালে জ্বলজ্বল করছে অদৃশ্য এক টীকা – ‘রিফিউজির বাচ্চা’ !

অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, আমাদের প্রায় প্রত্যেকের পূর্ব পুরুষ ঐ পাড়ে ধর্মীয় আগ্রাসনের শিকার হয়ে জেহাদীদের লাথি খেয়ে এপাড়ে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তু।

ছেচল্লিশের নোয়াখালী, পঞ্চাশের বরিশাল, বাষট্টির খুলনা, একাত্তর ….., ধাপে ধাপে সেদেশের সংখ্যালঘুদের এথনিক ক্লিনজিং করা হয়েছে। চলছে এখনও , তবে অন্য কায়দায় বেশ ধীর লয়ে চুপচাপ নীরবে ।

জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে সর্বস্ব ফেলে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় স্ত্রী সন্তান, যুবতী মেয়ে নিয়ে পালিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক জায়গায় সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ানো কতটা যে কষ্টের, কতটা যে অপমান জনক – তা শুধু ওরা জানে।  কিন্তু.. কিন্তু…,

ওরা তো আমাদের বলে নি, কোন পরিস্থিতিতে ওরা চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে এভাবে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছিল। ওরা তো বলে নি, শুধুমাত্র বিধর্মী হওয়ার অপরাধে চোখের সামনে কত প্রিয় জনকে নৃশংস ভাবে খুন হতে দেখেছেন, গণধর্ষিতা হতে দেখেছেন।

বাবার সামনে মেয়েকে, ছেলের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করে যৌনাঙ্গে ছুরি বা তরোয়াল দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে বর্বর পশুর দল।

যদি শুনি, চোখের সামনে শিকে বাঁধা স্বামী ভাই বা ছেলে জ্যান্ত আগুনে পুড়ছে, পাশেই খড় বিছিয়ে পরিবারের মহিলাদের পা দিয়ে সিঁদুর মুছিয়ে গণ ধর্ষণ করেছে পশুর চেয়েও পাশবিক বর্বররা; যদি শুনি এক বিছানায় শাশুড়ি, বৌ আর নাবালিকা নাতনি, একসাথে তিন প্রজন্মকে গণধর্ষণ করেছে ধর্মান্ধ পশুরা – স্নায়ূ অবশ হয়ে আসে না?

শায়েস্তা গঞ্জের চিত্তরঞ্জন রায় চৌধুরীর মত কত বাবা তাঁর নিজের আদরের সন্তানকে নিজের হাতে খুন করে আত্মঘাতী হয়েছেন ঐ ধর্মান্ধ জেহাদীদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ।

রিফিউজির

রিফিউজির
প্রত্যেকের কপালে জ্বলজ্বল করছে অদৃশ্য এক টীকা – ‘রিফিউজির বাচ্চা’ !

নিজেকে দিয়ে, নিজের সন্তানকে দিয়ে ভাবুন একবার ! কিন্তু সেই নৃশংস ইতিহাস ওরা আমাদের জানায় নি, আমরাও জানতে চাই নি। এক কল্পিত মিথ্যা একতরফা সম্প্রীতির নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখতে শাসকের নির্দেশে এই নৃশংস ইতিহাস আগাগোড়া লুকিয়ে রেখেছে এদেশের পেটোয়া ঐতিহাসিকরাও।

কিন্তু সবটা না জানলেও এটুকু তো জানি, আমাদের পূর্ব পুরুষদের ভিটে যে বাংলাদেশে ছিল। তাহলে মনে কেন প্রশ্ন জাগে না, সীমাহীন অত্যাচারের মুখে সব ফেলে আমাদের কেন এখানে চলে আসতে হল ?

প্রশ্ন জাগে না – যদি দেশভাগই কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ওদের কেন যেতে হয় নি ? ওদের কেন এই অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় নি? ধর্মের ভিত্তিতে যে দেশ ভাগ হয়েছিল, সেই ভাগের বিষ কেন আমাদেরই গিলতে হল?

আসলে এপাড়ে নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ আর বর্তমানের আপাত আত্মসুখে নিমজ্জিত বাঙালি এসব ভাবতেই চায় না। শুধু বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত বাঙালি প্রাণপণে যেন ভুলে থাকতে চায় সেই নৃশংস অতীত, শিকড় থেকে উপড়ে ফেলার যন্ত্রণা, মহীরুহ থেকে কচুরিপানার জীবনের অপমান !

আরো অদ্ভুত, যাদের এখানে আশ্রয় পেয়ে জাঁকিয়ে বসেছি, কোনঠাসা হয়ে পড়ার কারণে তাদের সঙ্গত যে ক্ষোভ, তা আমাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে, অথচ যাদের অত্যাচারে সব ছেড়ে এখানে এসে আশ্রয় নিতে হল, তাদের প্রতি কিন্তু আমাদের কোন ক্ষোভ নেই !

কিন্তু ছিন্নমূল আমাদের করলো কারা …?

অহমীয়ারা, তিপ্রাসারা, গজ্জুরা, নাকি মেড়েরা…? নাকি বাংলাভাষী আরবীরা? যাদের কারণে আজ এই কচুরিপানার জীবন, যারা অনেক গভীরে প্রোথিত শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে দিল এক লহমায় – তাদের প্রতি কিন্তু নেই বিন্দু মাত্র ক্ষোভ ! উল্টে যেন উথলে উঠে আমাদের ভাতৃত্ববোধ !

শুধু বাংলাভাষী বলে এই স্বভাব ধর্মান্ধ হায়েনাদের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে আবার ব্যবস্থা করছি ভেসে যাওয়ার ! অদ্ভুত বাঙালি মনস্তত্ব ! বাঙালি আখ্যা দিয়ে অনুপ্রবেশকারী সেই বাংলাভাষীদের সঙ্গে একাত্মতা দেখাচ্ছি, নিজেদের একসঙ্গে জুুড়ে দিচ্ছি তাদের সঙ্গে – যারা আমাদের বাঙালি বলে রেয়াত করে নি বাঙালির জন্য সৃষ্ট ‘জয় বাংলা’ য়, বাঙালি হয়েও যে বাংলাভাষীদের অত্যাচারেই আমাদের হতে হল ছিন্নমূল,

যারা ভবিষ্যতে উপযুক্ত পরিস্থিতিতে আবার ধারণ করবে স্বমূর্তি, আমাদের সেই অতীতই হবে আবার আমাদের ভবিষ্যত। ওরা তো পাল্টায় নি, পাল্টায় নি ওদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা ঐ হরফের নির্দেশ গুলিও। মিলিয়ে দেখুন, সব জায়গাতেই সংখ্যায় বাড়লেই ওদের চাই নিজস্ব আলাদা ধর্মীয় রাষ্ট্র, যেখানে অন্যদের ঠাঁই নেই । এবার আর কেউ কোথাও ঠাঁই দেবে না স্বার্থপর ব্যক্তিস্বার্থ সর্বস্ব মানসিকতার বিশ্বমানব এই তাত্ত্বিক বাঙালিকে।

ঘেন্না করে, ভীষণ ঘেন্না…, বাঙালি জাত্যাভিমানে সুড়সুড়ি দিতে যা যা করা হচ্ছে, বাঙালি হিসেবে খুব খারাপ লাগছে । আমাদের আশ্রয় দিয়ে আমাদের জন্য আজ ভূমিপুত্রদের অস্তিত্ব বিপন্ন। আমাদের মত অত্যাচারের সম্মুখীন না হয়েও এই অঞ্চলের ভূমিপুত্ররা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শত্রু সচেতন, অনেক বেশি জাতীয়তাবাদী, জানে নিজেদের রক্ষা করতে ।

একই রকম জনসংখ্যার অনুপাত হলেও পঃ বঙ্গে যেভাবে একতরফা ধুলাগড় বাদুুড়িয়া কালিয়াচক সমুদ্রগড় ক্যানিং ঘটেই চলেছে, আসামে এরকম আমরা কল্পনাও করতে পারি না।

ভাবতে অবাক লাগে, যে বাঙালি বুকের রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করেছিল, সেই বাঙালির বর্তমান প্রজন্মের একটা অংশ এক বিশেষ মতাদর্শের প্রভাবে আর নয়তো একতরফা কল্পিত এক সম্প্রীতির নেশায় বুঁদ হয়ে আজ অন্ধ। এদের স্বার্থপরতা আর অবিমৃশ্যকারীতার জন্য পুরো দেশের নিরাপত্তা আজ বিপদের মুখে।

ভাবতে আরো অবাক লাগে, ঐ ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিভৎস শিকার সবচেয়ে বেশি হতে হয়েছে বাঙালিকে, বাঙালি সবচেয়ে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে চাক্ষুষ করেছে ঐ ধর্মের স্বরূপ। অথচ বাঙালি অধ্যুষিত দেশের পূর্ব সীমান্তের অংশগুলি দিয়ে যে হারে অনুপ্রবেশ ঘটছে, পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ততটা হয় কি?

পাঞ্জাবও তো ভাগ হয়েছিল, পাঞ্জাবে নেই কেন এই অনুপ্রবেশ সমস্যা, পাঞ্জাবে কেন হয় না জেহাদীদের ঘাঁটি ? কেন এই বাংলায় হয়? বাঙালি অধ্যুষিত এই অংশগুলিকে করিডোর বানিয়েই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে অনুপ্রবেশকারীরা।

ঘেন্না, ভীষণ ঘেন্না হয়। বাঙালি নয়, নিজেকে একজন গর্বিত ভারতীয় হিসাবে ভাবতেই ভালো লাগছে এই পরিস্থিতিতে ।

রিফিউজির

আর পড়ুন…….