বেদ-বৈদিক-সভ্যতা-শ্রী-কৃষ্ণ-এবং-গীতা

বেদ, বৈদিক সভ্যতা, শ্রী কৃষ্ণ এবং গীতা।-দুর্মর

বেদ, বৈদিক সভ্যতা, শ্রী কৃষ্ণ এবং গীতা। বেদ এবং বেদ ভিত্তিক বৈদিক সভ্যতা কোন সময়ের এই নিয়ে মতানৈক্য আছে।

কিন্তু আজ এটা প্রমানিত হয়ে যাচ্ছে যে, বৈদিক সভ্যতা শুরু হয়েছিলো সিন্ধু-সরস্বতী নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। প্রাকৃতিক কারনে সরস্বতী নদী শুকিয়ে গেলে বৈদিক সভ্যতা বিস্তৃতি লাভ করে সিন্দু নদীর এবং বর্তমান গুজরাট অঞ্চলে।

ধীরে ধীরে সেই সভ্যতা বিস্তৃতি লাভ করে গঙ্গা- যমুনা- নর্মদা-কাবেরীর অববাহিকায়। এক সময় ভারত বর্ষের পরিধি ছাড়িয়ে , জ্ঞানী তপস্বীদের (ঋষি –মুনি) দের জ্ঞান লব্ধ সংষ্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমে মধ্য এশিয়া , হিন্দুকুশ-পামীর-কঁকেশাষ পেরিয়ে ইউরোপের লিথুয়ানিয়া, জার্মানী অবধি এবং পুর্বে কম্বোডিয়া ছাড়িয়ে ভিয়েতনাম অবধি।

বৈদিক সভ্যতার এই প্রসার ছিড়িয়ে ছিলো এক জ্ঞান ভান্ডারের ধারক এবং বাহকদের দ্বারা। সেই জ্ঞান ভান্ডারকে সনাতনিরা বলে “বেদ”।

বৈদিক সভ্যতার প্রসারে ঘোড়ার পিঠে চড়ে খোলা তলোয়ার নিয়ে মানুষের রক্তে হোলি খেলার কোনো প্রচেষ্টার প্রয়োজন পড়েনি। প্রত্নতাত্বিক গবেষনায় ঊঠে আসছে, বৈদিক যুগ শুরু হয়েছিলো কমপক্ষে ১০০০০ (দশ হাজার) বছর আগে।

আজ থেকে প্রায় ৯০০০ বছর আগে এক মহাজ্ঞানী মহাপুরুষ অবির্ভুত হয়েছিলেন এই গঙ্গা-যমুনার অববাহিকা অঞ্চলে। পরবর্তিতে তিনি তার নিকট জনদের নিয়ে চলে যান বর্তমান গুজরাটের ক্যাম্বে উপসাগরের মধ্যে, তট ভুমি থেকে সামান্য দূরে এক দ্বীপে, যার নাম দ্বারকা।

তার নাম শ্রী কৃষ্ণ, আর তার দ্বারকা আজ সমুদ্রের তলে বিদ্যমান। পন্ডিতেরা বলছেন সেই সদ্য আবিষ্কৃত জলের তলায় বিদ্যমান নগরী ৩ মাইল চওড়া আর ৭ মাইল লম্বা। স্থাপত্যের দিক দিয়ে  অতি অপুর্ব। আজ আর কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে মহাভারতে বর্নিত শ্রী কৃষ্ণ এবং দ্বারকা এক গল্প কথা নয়, বাস্তব সত্য ইতিহাস।

যেটা মেলে না সেটা হলো, মহাভারতের যুদ্ধের সময় এবং শ্রীকৃষ্ণের সমসাময়িক কাল। মহাভারতের যুদ্ধ কুরু –পাঞ্চালের যুদ্ধ , ৪০০০-৫০০০ বছর আগে হয়েছিলো। এক পক্ষে দ্রুপদ রাজার (পাঞ্চাল রাজ) ছেলে ধৃষ্টদুম্ন্য সেনাপতি (অর্জুন থাকতে ধৃষ্টদুম্ন্য কেনো?), অন্য পক্ষে কৌরব যুবরাজ দুর্য্যোধন।

গল্পটা এই খানে। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হঠাৎ করে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়। তার আগে তিনি অনেক কিছু করেছিলেন তা দেখি না মহাভারতে।

আছে শ্রী মদভাগতমে। এটাই সঙ্গত যে, মহাভারতের যুদ্ধের অনেক আগেই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব এবং ‘ভাগবত ধর্ম’ এর প্রচার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তিনি নিজে অনেক করেছিলেন, অর্জুনকে দিয়ে করিয়েওছিলেন।

হাজার হাজার বছরের পুরানো ইতিহাসের কোনটা কখন ঘটেছিলো তার খেই পাওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে লিখে রাখা অনেক কিছু ধংস হয়ে গেছে নানা কারনে।

সেই সব ঘটনা শ্রুতিতে (স্মরনে ) ছিলো গুরু শিষ্য পরম্পরায়। বেদব্যাস সেই সব লিখে সংকলিত করে রেখে গেছেন নৈমিষয়ারন্যে বসে তার ৫২০০০ সহযোগীকে নিয়ে।

বেদ ও ছিলো স্মৃতিতে (শ্রুতির মাধ্যমে=  শুনে শেখা)। লিপিবদ্ধ হলো পরে। বেদ উপনিষদের মধ্যে সুত্রাকারে লুকিয়ে আছে অনন্ত জ্ঞান ভান্ডার, যা চলে আসছে প্রায় ১০০০০ বছর ধরে।

বেদের কথা মানুষের মনের অন্ধকার দূর করে, মনের মধ্যে আলোকের ঝরনাধারা স্ফুরিত করে। এই সঞ্জীবনী সুধা হাজার হাজার জ্ঞানী তপস্বীর (মুনি ঋষি) ধ্যান মার্গে, এই বিশ্ব চরাচরে প্রবাহমান জ্ঞানের উপলব্ধি, আপ্ত্য বাক্য।

সাধারন সংসারী মানুষের পক্ষে সেই বিশাল জ্ঞান ভান্ডার খোজ করে তার থেকে নিজ কল্যানকারী তত্ব জ্ঞান লাভ করা নিশিচত ভাবে দুরূহ, অত্যন্ত আয়াসসাধ্য। অনেকের পক্ষে এক জীবনে তা লাভ করা সম্ভব নয়।

সবাই স্বামী বিবেকানন্দ হতে পারে না। সেই কারনেই সাধারন বুদ্ধির মানুষ অল্পজ্ঞানী কুট বুদ্ধি সম্পন্ন কৌশলী গুরু দের শিকার হয়ে পড়ে। শ্রী কৃষ্ণের ‘পুরূষোত্তম’  সঙ্গার ওপরে উঠের তারা হয়ে যান ‘পুরূষোত্তমম’।

ফল, পথ ভ্রষ্টতা আর সমাজে কলুষতার উদ্ভব (গীতার ভাষায় ‘কশ্মল মিদং’)। সেই থেকে তৈরী হয় অধর্ম আর অধার্মিকে ভরে যায় সমাজ। কষ্ট পায় কতিপয় ধর্মপ্রান মানুষ, তাই ঈশ্বর আবির্ভুত হন। ঈশ্বর সত্য ধর্ম পুনঃস্থাপিত করেন।

সেই সত্য ধর্মের পুনঃস্থাপনে শ্রী কৃষ্ণ ভাগবত ধর্ম (ভগবানের ধর্ম= ঈশ্বরের দেওয়া ধর্ম= ঈশ্বরের বানী= ঈশ্বরের উপদেশ= ঈশ্বরের দেওয়া জীবন পথে চলার রাস্তা= মানব জীবনের সংবিধান= দর্শন) প্রচার করেন। বেদ উপনিষদের সার সংক্ষেপ করে মাত্র ৭০০ শ্লোকে দিয়ে যান শ্রী গীতা। সেটাই সনাতনিদের এক বিশেষ ধর্ম গ্রন্থ।

বেদ কামধেনূ। মানব জীবনের সব সমস্যা এবং তার সমাধান বেদে দেওয়া আছে। বেদ মাতার মতো তার সন্তানদের নিজ স্তনদুগ্ধ পান করান।

শ্রীকৃষ্ণ কামধেনু রূপী বেদ মাতাকে ‘দোহন’ করেন। মোহগ্রস্থ অর্জুন সেই অমৃত পান করেন, তিনি  গোবৎস। গীতার সাতশো শ্লোক সেই “মাতা কাম ধেনূর  অমৃত দুগ্ধ’। গীতার অর্জুন শুধু এক শ্রীকৃষ্ণ ভক্ত, কিন্তু মোহ গ্রস্থ ক্ষত্রিয় যোদ্ধা নন।

তিনি মানব সমাজের পথভ্রষ্টদের প্রতিভু, প্রতীক। কুরুক্ষেত্রের রুদ্ররূপী শ্রীকৃষ্ণ এখানে মমতাময়, শান্ত ,জ্ঞানী পুরুষ। অধর্ম বিনাশী শ্রী কৃষ্ণের এক হাতে মানব সমাজ রক্ষার বল্গা, অন্য হাতে মানব কল্যানকারী ‘শ্রী গীতা’।

ঈশ্বর পুর্ন, সত্য, নিত্য, অব্যয়, অক্ষয়। তার অবতার যা করেন তা সৃষ্টির সব প্রানী , জড়, জঙ্গমের জন্যই করেন। কোনো ব্যাক্তি বিশেষ বা কোনো ভৌগলিক স্থানের কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্টি বা গোষ্টিপতির জন্য করেন না।

তিনি মত বিরোধীদের রক্ত পান করেন না। তিনি একথাও বলেন না যে, যারা আমাকে বিশ্বাস না করে, আমার পথে না চলে তাদের মারো কাটো, আর তাদের সম্পত্তি দখল করো।

নি অধর্মের বিনাশে দৈত্য দলন করেন,কখোনো মাতৃরূপে,কখনো যোদ্ধা রূপে, কখোনো সারথী রূপে, কখোনো গুরু রূপে। তার দেওয়া বানী তাই সব মানুষের জন্য,তাদের জীবন দর্শন। গীতা তাই কোনো সম্প্রদায়ের নয়, কোনো গোষ্টি বিশেষের নয়। সমগ্র মানব জাতির জন্যই শ্রী গীতা।

“বেদ, বৈদিক সভ্যতা, শ্রী কৃষ্ণ এবং গীতা”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ