কাশ্মীরী পন্ডিত

একজন হতভাগ্য কাশ্মীরী পন্ডিতের না বলা কথা—-

একজন হতভাগ্য কাশ্মীরী পন্ডিতের না বলা কথা। ১৯৯০ এর শরৎ ঋতুর আগমনের সাথেই কাশ্মীরের পাকিস্তান পন্থী জিহাদী মুসলমানদের প্রভূত্ব বিস্তার হয়েছিল। সেকুলার রাজ্য সরকার তাদের সমস্ত দায়িত্ব ভুলে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল এবং কোনো প্রকার শাসন ব্যবস্থা ছিল না।

জিহাদী মুসলমানরাই যেন পুরো কাশ্মীর উপত্তকার ভাগ্য নির্দেশ করছিল। এমন মনে হচ্ছিল যেন ভারতীয় হিন্দু হওয়া আমাদের কাছে অভিশাপ। মুসলমানরা রোজ হিটলিস্ট প্রকাশ করছিল। প্রত্যেক ভারতের সমর্থক হিন্দুকে গুপ্তচর আখ্যা দেওয়া হচ্ছিল।

তাদেরকে হত্যা করা ছিল তাদের কাছে পবিত্র কোরআনের অগণিত আয়াতের নির্দেশে বিধর্মী হত্যার জেহাদ অর্থাৎ পূণ্যের কাজ। বিশিষ্ট কাশ্মীরি হিন্দু পন্ডিতের আগে থেকেই টার্গেট করে মারা হচ্ছিল। সামাজিক কর্মী টিকালাল তাপ্লু’কে শ্রীনগরে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হল।

নীলকণ্ঠ গঞ্জুকে করননগরে হত্যা করা হল। আর ওঁর শব কয়েক ঘন্টা রাস্তাই পড়ে থাকল। দক্ষিণ কাশ্মিরের অনন্তনাগে ব্যারিস্টার প্রেমনাথ ভট্টকে নৃশংসতার সঙ্গে হত্যা করা হল। অগনিত অখ্যাত হিন্দু পণ্ডিতদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হল। বার্তা খুব স্পষ্ট।

৪ জানুয়ারী ১৯৯০ “আফতাব” দৈনিকে হিজবুল মুজাহিদিন একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সমস্ত হিন্দুদের উপত্যকা ছাড়তে বলল। আরেকটা দৈনিক “আল-সাফা” তেও একই বিজ্ঞপ্তি ছাপা হল। খুব তাড়াতাড়ি এই নোটিস কাশ্মীরি হিন্দুদের দরজায় সেঁটে দেওয়া হল।

১৯ জানুয়ারী ১৯৯০ এর সেই অভিশপ্ত রাতে উপত্যকাই এমন গ্রহণ লাগলো যেন অন্ধকার আলোর প্রতিটা কনাকে নিজের মধ্যে অন্তর্নিহিত করে ফেলেছে।

 

  1. কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিতাড়ন এক উপেক্ষিত সুপরিকল্পিত চক্রান্ত।
  2. ”দি কাশ্মীর ফাইলস” ম্যুভিটি, ”দি বাংলাদেশ ফাইলস” বা ”দি বাংলাদেশ হিন্দু ফাইলস” ম্যুভি তৈরীতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক।।
  3. কমরেড : কাশ্মীরের জন্য কাঁদেন আর প্রিয়া সাহাদের জন্য কাঁদেন না ?
  4. যে খবর হারিয়ে যায় বিস্মৃতির আড়ালে, তা কেঁদে মরে এখনও কাশ্মীরের উপত্যকায় চিনারের বনে, ঝিলামের স্রোতে।

 

কাশ্মীর
কাশ্মীরে ফেরা হিন্দু পন্ডিতদের ঘর

কাশ্মিরের প্রতিটা রাস্তার মোড় থেকে, প্রতিটা গ্রাম, শহর, গলি থেকে এমন বার্তা ভেসে আসতে লাগলো যা পণ্ডিতদের জন্য যেন মৃত্যু পরোয়ানা। সহস্র-লক্ষ্য লোকের ভিড় বিষাক্ত শ্লোগানে আকাশ কাঁপিয়ে তুলেছিল, যা আগে কোনদিন শোনাও যায়নি, দেখাও যায়নি।

পুরো কাশ্মিরে মসজিদ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছিল “কাশ্মির পাকিস্তান হবে”, মুজাহিদিনের প্রশংসার গুনগান করা হচ্ছিল। আর চারিদিকে বন্দুক উঁচিয়ে মিছিল বেরহচ্ছিল। “জাগো জাগো, সুভা হুয়ি, রুশনে বাজী হারী হে – হিন্দপে লাররা তারি হে – অব কাশ্মির কি বারি হে”।

বারবার এই স্লোগান মসজিদ থেকে চালান হচ্ছিল। “আগার কাশ্মির মে রাহানা হে, ‘আল্লা হু আকবর’ কেহনা হোগা”। “এই জালিমো এই কাফিরো, কাশ্মির হামারা ছোর দো”। এই শ্লোগান গুলো যেন থামছিলই না। একটা বন্ধ হচ্ছিল তো আরেকটা শুরু হয়ে যাচ্ছিল।

এই শ্লোগান গুলোর মধ্যেই একটা ছিল “কাশ্মির বনেগা পাকিস্তান, পণ্ডিত আদমিওঁ কে বাগায়ের পর পণ্ডিত আউরতওঁ কে সাথ”। এই শ্লোগানটা জোরে জোরে পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছিল।

প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের ভয় নতুন রূপ নিচ্ছিল। পরিবারের মহিলাদের স্টোর রুমে আত্মগোপন করানো হয়েছিল এই কথা বলে যদি ভিড় আক্রমন করে, তারা যেন গায়ে আগুন দিয়ে নেয়।

সেই রাতের ভয়ের কোন তুলনা হয় না, হতাশার এমন মুহূর্ত যেন শেষ হতেই চাইছিলই না। বার্তা স্পষ্ট আর তীব্র, “রলিভ, গলিভ ইয়া জলিভ” অর্থাৎ হয় আমাদের দলে এসো, নতুবা মরো, অথবা পালিয়ে যাও। কোন একটা পাড়া, গ্রাম বা জায়গা ছিল না যেখানে এই শ্লোগান গুলো শোনা যাচ্ছিল না।

এই বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যে অধিকাংশ কাশ্মীরি পণ্ডিত সঙ্গে যা পেরেছে নিয়ে, কোন রকমে প্রাণ ও সম্মান বাঁচিয়ে, ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে, বাসে বা, ভাড়ার গাড়ি করে পলায়ন করল। বিপুল পরিমানে পলায়ন শুরু হয়ে গেল।

কাশ্মীরী পন্ডিত
১990 সালের ১ জানুয়ারি কাশ্মীর থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের শত্যাগের স্মারক, যার স্মৃতি আজও স্পষ্ট।

 

সরকার, বুদ্ধিজীবী, সেকুলার, মার্ক্সবাদী, নিরপেক্ষবাদি সবার অন্তরাত্মা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কেউ এই ব্যাপারে মুখ খোলেননি। ১৯ জানুয়ারী ১৯৯০ এর পরের দিনগুলোতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গনহত্যা শুরু হয়। আর আমাদের উপর অত্যাচারের চরম সীমা অতিক্রম করেছিল।

বান্ধিপুরাতে শিক্ষিকা গিরিরাজ টিক্কুর গ্যাং রেপের পর হত্যা করা হল। এই ধরনের খবর হামেসাই শোনা যাচ্ছিল। এর উপর পুরো বই লেখা যেতে পারে, কিভাবে হিন্দুরা পাকিস্তান পন্থী জিহাদী মুসলমানদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছিল। আর কিভাবে সেকুলার প্রশাসন মূক দর্শক হয়ে শুধু তামাশা দেখে যাচ্ছিল।

১৯৯১ পর্যন্ত বেশীরভাগ পণ্ডিত পরিবার উপত্যকা থেকে পলায়ন করেছিল। আর তাদেরকে জম্মুর ক্যাকটাসে পূর্ণ দুর্গম স্থানে টেনট শিবিরে রাখা হল। ৬০-৮০ হাজারের বেশি পরিবার পলায়ন করেছিল, যাদে সংখ্যা ৪-৭ লক্ষ্যের উপর ছিল। তাদেরকে এমন শিবিরে রাখা হয়েছিল যেখানে শৌচালয়ের মত ন্যুনতম সুবিধাও ছিলনা।

এক একটা পরিবারকে একটাই তাঁবু দেওয়া হয়েছিলো যাতে তারা একসাথে ১০-১২ জন পর্যন্ত থাকত। এই শিবির গুলোতে ব্যাপক হারে মৃত্যুও হয়েছে। আর বেশিরভাগই হয়েছে সাপের কামড়ে আর অত্যাধিক গরমের কারণে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের যেন মরার জন্যই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো।

পণ্ডিতদের হাজার-হাজার ঘর বাড়ি মন্দির সব ধুলিস্যাত করে দেওয়া হয়েছিল। আর সবই এই সংস্কৃতিপূর্ণ ধর্ম-নিরপেক্ষয় ভারতবর্ষে ঘটছিল। আর পণ্ডিতদের যে কয়েক জন উপত্যকায় বাধ্য হয়ে রয়ে গেছিল তাদের সবাইকে মহান আল্লাহতালার নামে গণহত্যা করা হয়েছিল।

লেখক- রেজাউল মানিক

আর পড়ুন…….