মাত্র ৭ মাসের স্বাধীনতা: বালুচিস্তানের অজানা ইতিহাস | একটি গভীর বিশ্লেষণ

Balochistan

মাত্র ৭ মাসের স্বাধীনতা: বালুচিস্তানের না বলা ইতিহাস ও ৭৫ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম

ইতিহাসের পাতা থেকে প্রায় মুছে ফেলা এমন এক দেশের গল্প কি আপনি জানেন, যা ভারত বা পাকিস্তানেরও আগে জন্মেছিল কিন্তু মাত্র কয়েক মাস পরেই মানচিত্র থেকে হারিয়ে গিয়েছিল? দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থিত বালুচিস্তান—এক নাম যা একই সাথে খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য এবং দীর্ঘস্থায়ী এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রতীক। কেন এই অঞ্চলের আকাশে আজও শান্তির দেখা নেই? এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৭৫ বছর পেছনে, এক বিতর্কিত অন্তর্ভুক্তির রহস্যময় অধ্যায়ে।

ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়: স্বাধীন কালাত রাজ্য

বেশিরভাগ মানুষই জানেন না যে, ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ারও তিন দিন আগে, ১১ই আগস্ট ১৯৪৭-এ, বালুচিস্তান (তৎকালীন কালাত রাজ্য) ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; এই স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছিল। তৎকালীন নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এই খবর ফলাও করে ছাপা হয় এবং নতুন দিল্লি ও করাচিতে তাদের নিজস্ব দূতাবাসও স্থাপন করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই স্বাধীন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ তখন উজ্জ্বল বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু সেই স্বাধীনতা ছিল ক্ষণস্থায়ী।

 

বিতর্কিত অন্তর্ভুক্তি: স্বাধীনতার ৭ মাস পর

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিহাস হলো, যিনি একসময় কালাতের স্বাধীনতার জন্য আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছিলেন, সেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর এই ভূখণ্ডটিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন সূত্র এবং ফ্যাক্ট ডেস্কের মতো সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কালাতের তৎকালীন শাসক, মীর আহমেদ ইয়ার খান, প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত এই চাপ প্রতিরোধ করেছিলেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগ করে বালুচিস্তান দখল করে নেয়। অভিযোগ ওঠে, খানকে প্রায় বন্দুকের মুখে একটি অন্তর্ভুক্তির চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এই একটি বিতর্কিত ঘটনাই জন্ম দেয় এক গভীর ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের, যা পরবর্তী ৭৫ বছর ধরে এই অঞ্চলের অস্থিরতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংঘাতের জন্ম এবং দশকের পর দশক অস্থিরতা

প্রথম বিদ্রোহ (১৯৫০-৭০ দশক):
পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তির পর থেকেই অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৫০-এর দশকে যখন “এক ইউনিট নীতি”র মাধ্যমে বালুচিস্তানের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখনই প্রথম বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এরপর ১৯৭০-এর দশকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচনে জিতে প্রাদেশিক সরকার গঠন করলেও, সামরিক হস্তক্ষেপে সেই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যা সংঘাতকে আরও তীব্র করে তোলে।

আধুনিক সংঘাত ও BLA-র উত্থান:
২০০০-এর দশক থেকে সংঘাত এক নতুন এবং আরও মারাত্মক রূপ নেয়। বর্ষীয়ান বালুচ নেতা আকবর বুগতিকে ২০০৬ সালে হত্যা করার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এই সময়েই বালুচ লিবারেশন আর্মি (BLA)-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটে, যারা আর শুধু স্বায়ত্তশাসন নয়, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই শুরু করে।

কেন বালুচিস্তান এত গুরুত্বপূর্ণ? ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

বালুচিস্তানের এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের পেছনে রয়েছে এর বিপুল ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব।

  1. খনিজ সম্পদ: এই অঞ্চলটি প্রাকৃতিক গ্যাস, তামা, সোনা এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। কিন্তু বালুচ জাতীয়তাবাদীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, এই সম্পদের সুফল তারা পায় না, বরং সবটাই পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশ, বিশেষ করে পাঞ্জাব, ভোগ করে।

  2. কৌশলগত অবস্থান: বালুচিস্তানের রয়েছে আরব সাগরের উপকূলে এক দীর্ঘ সৈকত এবং গোয়াদর বন্দর। এই বন্দরটিই বর্তমানে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর কেন্দ্রবিন্দু। চীনের বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে এই বন্দরটি মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে সংযোগের এক প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে, যা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বর্তমান সংকট

দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সংঘাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। জোর করে গুম করে দেওয়া, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের মতো ঘটনা এই অঞ্চলের মানুষের মনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি এক গভীর আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। আফগানিস্তানে তালেবানের প্রত্যাবর্তনের পর তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (TTP)-এর মতো গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা বাড়ায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী সেইদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর এই সুযোগে বালুচ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের তৎপরতা প্রায় চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়।

উপসংহার: এই প্রশ্নের শেষ কোথায়?

ঐতিহাসিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক শোষণ, জাতিগত বিভেদ এবং আন্তর্জাতিক শক্তির ভূ-রাজনৈতিক খেলা—এই সবকিছু মিলে বালুচিস্তানের পরিস্থিতিকে এক জটিল সংকটে পরিণত করেছে। যখন একটি অঞ্চলের মানুষ দশকের পর দশক ধরে নিজেদের অধিকার হারানোর অভিযোগ করে আসছে, আর ঠিক সেই সময়েই বাইরের বিভিন্ন শক্তি সেই অঞ্চলটিকে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে, তখন সেখানে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ খুঁজে বের করাটা কতটা কঠিন? শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে কি এই গভীর ক্ষতের কোনো স্থায়ী সমাধান আসলেই সম্ভব? এই প্রশ্ন আজও উত্তরহীন।

 

মার্কিন শুল্ক: বাণিজ্য যুদ্ধের আড়ালে নতুন পরাশক্তির উত্থান? ভারত-মার্কিন সংঘাতের নেপথ্যের খেলা!

 

Scroll to Top